কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাঁর উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিস ভারতে তুর্কী শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর নীতি ও নেতৃত্ব সদ্য প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
(১) ক্ষমতার উত্থান: কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর তাঁর দত্তকপুত্র আরামশাহ কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু শাসক হিসাবে তিনি ছিলেন অযোগ্য। এই অবস্থায় দিল্লীর ওমরাহগণ কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও বদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিসকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ইলতুৎমিস সসৈন্যে দিল্লী রওনা হন এবং আরামশাহকে পরাজিত ও নিহত করে ১২১১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন অধিকার করেন।
(২) অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সঙ্কট: ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই ইলতুৎমিস বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সঙ্কটের সম্মুখীন হন। গজনির অধিপতি তাজউদ্দিন ইলদুজ ও সিন্ধুর শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচা ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এছাড়া উত্তর ভারতের মুসলিম ওমরাহগণ ইলতুৎমিসের প্রভুত্ব স্বীকার করতে চাননি। বাংলার তৎকালীন শাসনকর্তা খলজি আলিমর্দান দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
ইলতুৎমিস একে একে এই সব বিপদ কাটিয়ে উঠলেন। প্রথমে তিনি তাজউদ্দিন ইলদুজকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করেন। সিন্ধুর শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচাও তাঁর অধীনতা মেনে নেন। এরপর ইলতুৎমিস বাংলার শাসক গিয়াসুদ্দিন খলজির বিদ্রোহ দমন করলেন। ১২৩১ খ্রীষ্টাব্দে গোয়ালিয়রের হিন্দু রাজা মঙ্গলদেবকে পরাজিত করে ইলতুৎমিস গোয়ালিয়র দখল করেন। এর দুই বৎসর পর মালব আক্রমণ করে ভিলসা দূর্গ অধিকার করেন। সবশেষে তিনি উজ্জয়িনী অধিকার করেন।
(৩) চেঙ্গিস খাঁর অভিযান: ইলতুৎমিস একদিকে যখন অভ্যন্তীরণ গোলযোগ দমনে ব্যস্ত সেই সময় বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খাঁ খিবার অধিপতি জালালউদ্দিন মঙ্গবাণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই অবস্থায় জালালউদ্দিন ভারতে এসে উপস্থিত হন এবং ইলতুৎমিসের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কিন্তু বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ইলতুৎমিস তাঁকে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়ে চেঙ্গিস খাঁর বিরাগভাজন হতে চাইলেন না। ইলতুৎমিসের কাছে আশ্রয় না পেয়ে জালালউদ্দিন পারস্যে চলে গেলে। চেঙ্গিস খাঁ পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের অনেক অঞ্চল বিধ্বস্ত করে ভারত ত্যাগ করেন। এইভাবে ইলতুৎমিস এক গভীর সংকটের হাত থেকে সুলতানী রাজ্যকে রক্ষা করেন।
(৪) খালিফার অনুমোদন: ইলতুৎমিস একদিকে সুলতানি রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করেছিলেন, অন্যদিকে তিনি সদ্য-প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাজ্যকে আইনগত মর্যাদা দিতে সচেষ্ট হন। ১২২৯ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদের খলিফার কাছ থেকে তিনি ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি লাভ করেন। এর ফলে ধর্মগুরু খলিফার সমর্থিত শাসকরূপে ইলতুৎমিসের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
ইলতুৎমিসকে ভারতে সার্বভৌম মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। তিনি একটি শাসকগোষ্ঠীর ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি যে প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপন করেন তা সারা সুলতানি আমলে অব্যাহত থাকে। তিনি সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহু বিদেশী পণ্ডিতদের আশ্রয় দিয়ে তিনি দিল্লীকে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করেন। তাঁর আমলেই দিল্লীর কুতুব মিনারের নির্মাণ শেষ হয়। এইসমস্ত কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।