কোনো সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য শক্তিই যথেষ্ট নয়। সুবিন্যস্ত ও সু-নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থার উপর তা বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিজয়নগরের নরপতিরা এক সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। অল্পকালের সময়সীমায় বিজয়নগর রাজ্যে চারটি বংশকে রাজত্ব করতে দেখা যায়। দক্ষিণ-ভারতের প্রতিবেশী বাহমনি রাজ্য সদা-সর্বদা বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে গ্রাস করতে উদ্যত ছিল। অবশ্য বিজয়নগরের শাসকেরা রাজ্যের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং সু-নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শাসনের প্রয়োগ দ্বারা মোকাবিলা করেছিলেন।
কেন্দ্রীয় শাসন: বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বেসর্বা। রাজা শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সমর বিভাগের সর্বেসর্বা হলেও, তিনি স্বৈরাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তিনি দেশশাসন করতেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায় তাঁর ‘আমুক্ত মাল্যদা’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “ধর্মের প্রতি লক্ষ রেখে রাজ্য শাসন করাই রাজার কর্তব্য।” শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রীসভা ছিল এবং মন্ত্রীগণ রাজা-কর্তৃক নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। ব্রাহ্মাণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—তিন শ্রেণি থেকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হত, যদিও ব্রাহ্মণরা প্রাধান্য পেত। মন্ত্রীপদ অনেক সময় বংশানুক্রমিক হত। প্রধানমন্ত্রীকে বলা হত মহাপ্রধান। তিনি বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতেন। মন্ত্রীদের সংখ্যা ছিল সাধারণত ৬ থেকে ৮ জন। মন্ত্রী ব্যতীত কোষাধ্যক্ষ, বাণিজ্য সচিব, পুলিশ বাহিনীর অধিনায়ক, অশ্ববাহিনীর অধিনায়ক প্রভৃতি বিভিন্ন রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিজয়নগরের রাজারা জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা স্থাপন করেছিলেন। এই সভা বহুসংখ্যক পণ্ডিত, পুরোহিত, সাহিত্যিক, জ্যোতিষী ও সংগীতজ্ঞ দ্বারা অলংকৃত ছিল। পারস্যের রাজদূত আবদুর রজ্জাক ও পর্তুগিজ পর্যটক নুনিজ বিজয়নগরে ‘মহাকরণ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রাদেশিক শাসন: শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র বিজয়নগর সাম্রাজ্য কয়েকটি মণ্ডলম বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ বিজয়নগরে ২০০টি প্রদেশের কথা বলেছেন। তবে, এই বক্তব্য সঠিক নয়। ডঃ কৃষ্ণশাস্ত্রীর মতে, বিজয়নগর সাম্রাজ্যে প্রদেশের সংখ্যা ছিল ৬টি। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ‘নায়ক’ বা ‘নায়ঙ্কারা’ বলা হত। তাঁরা সাধারণত রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতেন। নিজ নিজ এলাকায় তাঁরা কর্মচারী নিয়োগ করতেন, বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, রাজস্ব আদায় করতেন এবং সম্রাটের প্রয়োজনে সেনা সরবরাহ করতেন। তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজসভা ও সেনাবাহিনী ছিল। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজ নিজ এলাকায় শাসনকার্য পরিচালনা করলেও কেন্দ্রের সঙ্গে সর্বদাই তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলতে হত।
প্রদেশগুলি আবার নাড়ু বা জেলায় এবং জেলাগুলি আবার স্থল বা মহকুমায় এবং স্থলগুলি গ্রাম-এ বিভক্ত ছিল। গ্রাম ছিল শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। গ্রামগুলি স্বশাসন ভোগ করত এবং সেখানে পঞ্চায়েত-এর উপর গ্রামের পুলিশ, বিচার ও শাসনভার ন্যস্ত ছিল। উত্তর-ভারতের পঞ্চায়েতের মত দক্ষিণে গ্রাম্য ‘সভা’ শাসন পরিচালনা করত। গ্রামীণ প্রশাসনিক কর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেনাতোভা বা হিসাবরক্ষক, তলরা বা পরিদর্শক, বেগারা ইত্যাদি। এই সকল কর্মচারী তাদের বেতন হিসেবে জমি ভোগ করতেন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে গ্রামীণ প্রশাসনের সংযোগ রক্ষা করতেন ‘মহানায়কাচার্য’ নামক কর্মচারী।
রাজস্ব ব্যবস্থা: খেয়া, পথকর, শিল্পকর, বাণিজ্য-শুল্ক, বিক্রয়-কর, বিবাহ-কর, গোচারণ-কর প্রভৃতি থেকে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হলেও ভূমিকর ছিল সরকারি আয়ের প্রধান উৎস। জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে ভূমিরাজস্ব নির্ধারিত হত। উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমিরাজস্ব হিসেবে গৃহীত হত। অর্থ বা শস্য দ্বারা রাজস্ব রাজস্ব দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। রাজস্ব-সংক্রান্ত সকল কার্য পরিচালনার জন্য একটি পৃথক দপ্তর ছিল।
সামরিক বাহিনী: সামন্তসেনা ছাড়াও রাজার নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল। পদাতিক, অশ্বারোহী, গোলন্দাজ, উষ্ট্র ও হস্তিবাহিনী নিয়ে সরকারের সেনাবাহিনী গঠিত ছিল। সেনাদলে হিন্দু-মুসলিম সকল সামরিক বিভাগ সম্প্রদায়ের লোক নেওয়া হত। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিল বিশাল। কৃষ্ণদেব রায়ের সেনাবাহিনীতে ৭ লক্ষ পদাতিক, ৩৬০০টি অশ্ব ও ৬৫০টি হস্তি ছিল। এ সময় গোলন্দাজ বাহিনীরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেনাদলকে শক্তিশালী করার জন্য পর্তুগিজদের সাহায্যে আরবদেশ থেকে ভালো ঘোড়া আনা হত এবং তুর্কি তিরন্দাজ নিয়োগ করা হত। সেনাবিভাগের তত্ত্বাবধান করত ‘কাণ্ডাচার’ নামক একটি দপ্তর। এই দপ্তরের প্রধান ছিলেন প্রধান সেনানায়ক বা ‘দণ্ডনায়ক’। বিজয়নগরের রাজারা নৌ-বাহিনীর প্রতি উদাসীন ছিলেন।
বিচার বিভাগ: রাজা ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারক ও আইন-প্রণেতা। অন্যান্য বিচারকগণ রাজা কর্তৃক মনোনীত হতেন। প্রজাদের সুবিধার্থে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে তিনি বহু বিচারালয় বিচার স্থাপন করেন। গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতের উপর বিচারের ভার ন্যস্ত ছিল। দেশে দণ্ডবিধি ছিল খুবই কঠোর। দোষী ব্যক্তির জরিমানা, কারাবাস ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত। অপরাধীর অঙ্গছেদ-এমনকী প্রাণদণ্ড প্রচলিত ছিল।
শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি: বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ত্রুটিহীন ছিল না। (১) প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বল সম্রাট সিংহাসনে বসলেই তারা স্বাধীনতা ঘোষণার সুযোগ খুঁজত। (২) তাদের সামরিক ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ কারণ সাধারণভাবে সামন্তপ্রভুরাই যুদ্ধের সময় সেনা পাঠিয়ে রাজাকে সাহায্য করত এবং এর ফলে রাজা সম্পূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন। (৩) প্রচুর সুযোগ এবং সমুদ্র ও নদীবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও বিজয়নগরের শাসকবর্গ ভারতের অভ্যন্তরে বাণিজ্য-বিস্তারের কোনও চেষ্টা করেন নি—তাঁদের অর্থনীতি কৃষি-সম্পদের উপর নির্ভরশীল ছিল। (৪) অধিক শুল্ক লাভের আশায় তাঁরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের বসবাসের সুযোগ করে দেন—যা পরবর্তীকালে মারাত্মক বলে পরিগণিত হয়।