‘গণতন্ত্র’ কথাটি বর্তমান সমাজ জীবনে বহু আলোচিত এবং বহুল প্রচারিত, কিন্তু গণতন্ত্রের তাৎপর্য সম্পর্কে সকলে একমত পোষণ করেন না। প্রাচীন গ্রীসের মনীষিগণ থেকে শুরু করে বর্তমান কালের লেখক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ গণতন্ত্রকে অন্যতম আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি, সরকারের রূপ এবং জীবনযাপন পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে গণতন্ত্র কথাটি ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রাচীন গ্রীসে গণতন্ত্র কথাটির প্রথম প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজি ‘Democracy’ কথাটির দুটি গ্রীক শব্দ Demos ও Kratos থেকে এসেছে। Demos অর্থ হল জনগণ এবং Kratos শব্দের অর্থ হল ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব। সুতরাং গণতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘জনগণের কর্তৃত্ব বা শাসন।
◇ গণতন্ত্রের সুবিধা বা গুণ
যুগ যুগ ধরে গণতন্ত্রের আদর্শ সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন যুগের রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও চিন্তানায়কগণ গণতন্ত্রের তাৎপর্য ও মূল্য সম্পর্কে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। প্রাচীন গ্রীসের এরিস্টটল থেকে শুরু করে জন স্টুয়ার্ট মিল, বন্থাম, হকিং, ব্রাইস, বার্কার প্রভৃতি লেখকগণ গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। অপরদিকে হেনরী মেইন, লেকী, ব্লুণ্টরী, ট্রিক্সকে, গিভিংস প্রমুখ চিন্তাবিদ গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। মার্কসবাদী লেখকগণ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের তীর সমালোচনা করলেও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন।
(১) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়: অধ্যাপক বার্কারের মত অনুযায়ী গণতন্ত্র একমাত্র শাসনব্যবস্থা যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক সত্যের উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন সকলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও ভাববিনিময়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আলাপ-আলোচনা এবং ভাববিনিময়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এর জন্যই গণতন্ত্রকে যথার্থ আলাপ-আলোচনার ওপর প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করা যায়।
(২) স্বাধীনতা ও সাম্যের স্বীকৃতি: গণতন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করে। ব্যক্তির বিকাশের জন্য স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার একান্ত প্রয়োজন। গণতন্ত্র তা স্বীকার করে বলে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে আত্মবিকাশের পথ খুঁজে পায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের জন্মগত, বংশগত বা সম্পদগত কৃত্রিম সামাজিক বিভেদ গণতন্ত্র স্বীকার করে না। এই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণে সকলের সমান সুযোগ ও অধিকার স্বীকৃত।
(৩) সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ব্যাপক কল্যাণ সম্ভব হয়: বেন্থামের মতে, সুশাসনের প্রধান সমস্যা হল শাসক ও শাসিতের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে জনগণের ব্যাপক কল্যাণ সাধন করা। সাধারণ মানুষই সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপলব্ধি করতে পারে। সুতরাং শাসিতকে শাসকের পদে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই সুশাসন সম্ভব হবে। যে শাসনব্যবস্থায় শাসকগণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত, তাদের প্রতি দায়িত্বশীল সেই শাসনব্যবস্থায় জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সম্ভব হয়।
(৪) আত্ম-শাসনের সুযোগ: ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হল আত্ম-শাসন। মিলের মতে সুশাসনই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, জনগণের মানসিক উন্নতিও অন্যতম উদ্দেশ্য। শাসনকার্যে ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণ সুশাসনের শিক্ষালাভ করতে পারে, আত্মবিকাশের সুযোগ লাভ করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই আত্মশাসনের সুযোগদানে ব্যক্তিকে দায়িত্বশীল করে তোলে।
(৫) ব্যক্তির উপযুক্ত মর্যাদার স্বীকৃতি ও চারিত্রিক উন্নতি: গণতন্ত্র ব্যক্তিজীবনে নতুন মূল্যবোধের সঞ্চার করে এবং ব্যক্তিকে মহান মর্যাদায় ভূষিত করে। ব্যক্তি-জীবনে পূর্ণাঙ্গ বিকাশের সম্ভাবনার সঙ্গে উদার দৃষ্টিভঙ্গী গঠন ও চারিত্রিক উন্নতিও সম্ভব হয়। ব্যক্তিগত জীবনের পূর্ণতা উন্নততর জাতীয় চরিত্র গঠনের পথ প্রশস্ত করে।
(৬) রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ঘটে: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শিক্ষাগত মূল্য উপেক্ষা করা যায় না। শাসনব্যবস্থায় সকলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে বলে সাধারণের আগ্রহ ও উৎসাহের সঞ্চার হয়। নির্বাচনের সময় দেশের বিভিন্ন সমস্যাবলী সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার, আলাপ-আলোচনা, বক্তৃতা, প্রচার পুস্তিকা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ হয় এবং চেতনার বিকাশ ঘটে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের গণ্ডী অতিক্রম করে বৃহত্তর পটভূমিকায় মানুষ চিন্তা করতে শেখে এবং সার্বিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়।
(৭) শাসকের স্বৈরাচার প্রতিরোধ করে: গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসিতের প্রতি শাসকের ধায়িত্বশীলতা সুনিশ্চিত হতে পারে। শাসকের দায়িত্বশীলতা বলবৎ করবার সুযোগ না থাকলে, ক্ষমতার ওপর বাধানিষেধ না থাকলে শাসকের পক্ষে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে স্বৈরাচারী হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু গণতন্ত্র জনমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা বলে শাসকের পক্ষে জনমতের বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব নয়।
(৮) দেশপ্রেম গভীর করে: অনেক লেখকের মধ্যে, একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশপ্রেম জাগ্রত। করতে পারে। এই শাসনব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ স্বীকৃত বলে জনগণ একে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা বলে গ্রহণ করতে পারে। ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডী অতিক্রম করে বৃহত্তম স্বার্থের জন্য কাজ করবার প্রেরণায় জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়। গণতন্ত্রকে সংরক্ষণ করবার জন্য মানুষ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে। দেশের প্রতি জনগণের ভালবাসা গভীরতা লাভ করে। গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে গভীর দেশপ্রেম সমাজ ও জাতির প্রগতির পথ উন্মুক্ত করে। গণতান্ত্রিক চেতনার গভীরতা যথার্থ দেশপ্রেমকে আন্তর্জাতিকতার মহান আদর্শ প্রসারিত করতে পারে।
(৯) বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস পায়: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিপ্লব বা বিদ্রোহের সম্ভাবনা হতে অনেকাংশে মুক্ত। ইহা বুলেট অপেক্ষা ব্যালটের ওপর অধিক আস্থাশীল। জনগণ সহজেই জনগণের স্বার্থের বিরোধী সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে। দেশের প্রচলিত আইন-কানুনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথেই এই পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে, কোন রক্তাক্ত বিপ্লবের পথ অনুসরণ করতে হয় না।
◇ গণতন্ত্রের অসুবিধা বা দোষ
পৃথিবীতে গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রচার ও সমর্থন সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনার ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য ও তীব্রতাও কম নয়। সমালোচকগণের দৃষ্টিভঙ্গীকে বা আক্রমণকে মোটামুটি দুটি বিশিষ্ট ধারায় বিভক্ত করা যায়—প্রথমত, গণতন্ত্র অক্ষম ও অযোগ্যের শাসনব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিতান্তই অস্থায়ী, ক্ষণভঙ্গুর।
(১) অক্ষম ও অযোগ্যের শাসনব্যবস্থা: সমালোচকগণের মতে, শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে শাসকগণের দক্ষতা, শিক্ষা ও বিচার-বিবেচনার ওপর। গণতন্ত্রের শিক্ষা ও গুণগত যোগ্যতার বিশেষ সমাদর নেই ও গুণগত যোগ্যতা অপেক্ষা সংখ্যার ওপর প্রাধান্য আরোপ করা হয়। অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত, চোর, ডাকাত, দুষ্কৃতী ও রাজনৈতিক চেতনাহীন বলেই অজ্ঞতা, অশিক্ষা ও অযোগ্যতাই শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। লেকী গণতন্ত্রকে ‘সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ ও সর্বাপেক্ষা অকর্মণ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
(২) নেতৃত্ব নিম্নস্তরের: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নেতৃত্বের যোগ্যতাকে বিশেষ সমালোচনা করা হয়েছে। র্যাঙ্ক ক্র্যাম ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন, ধর্ম, কলা, শিক্ষা ও শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব অতীত দিনের নেতৃত্ব হতে বিশেষ নিম্নমানের। নির্বাচনের মাধ্যমেই নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি স্বীকৃত হওয়ায় অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব লাভের সুযোগ ঘটে। ফরাসী লেখক ফ্যাগুয়ের মতে, সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞান নেতৃবৃন্দের থাকে না বলে সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রে নেতৃত্ব দুর্বল হয়।
(৩) প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব হয় না: সমালোচকগণ বলেন, গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। সমাজের অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞ ও অশিক্ষিত বলে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না। গতানুগতিকতার বাইরে সকল কাজ ও মতামতকে অশিক্ষিত জনগণ সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখে বলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সুতরাং গণতন্ত্রে ব্যক্তিত্বের যথার্থ বিকাশ এবং স্বাধীনতার উপলব্ধি অপেক্ষা তাদের প্রতিবন্ধকতাই অধিক পরিলক্ষিত হয়।
(৪) নৈতিক অবনতির সুযোগ ঘটে: গণতন্ত্রের নৈতিকমূল্য সম্পর্কেও বিভিন্ন লেখক তীব্র সমালোচনা করেন। অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনসাধারণকে বাক্পটুতা ও চাতুর্যে বিভ্রান্ত করে সহজেই কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন। জনগণের সমর্থন লাভের জন্য নানাপ্রকার মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়। জনগণের রাজনৈতিক চেতনার অভাবে দুর্নীতি ও ব্যাপক মিথ্যার সুযোগ ঘটে। উৎকোচ প্রদান, উৎকোচ গ্রহণ, নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ প্রভৃতি কাজ গণতন্ত্রের নৈতিক মূল্য বিনষ্ট করে অজ্ঞ ও অশিক্ষিত জনগণ দুর্নীতি ও প্রলোভনের শিকার হয়ে সমাজজীবনের নীতিবর্জিত এক বিষাক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করে যা গণতন্ত্রের আদর্শকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে।
(৫) শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানের পরিপন্থী: হেনরী মেইন, লে বুন প্রমুখ লেখকগণের মতে গণতন্ত্র শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, বিজ্ঞান প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তিগুলির পরিপন্থী। সাধারণ অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা বা বিজ্ঞানের যথার্থ গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। সুতরাং শিল্প, সাহিত্য বা বিজ্ঞানের বিকাশে তারা সচেষ্ট হয় না।
(৬) গণতান্ত্রিক সভ্যতাও নিম্নস্তরের: জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীতে গণতন্ত্রকে ‘বন্য, সাধারণ ও স্কুল’ সভ্যতার অনুকূল বলে মনে করা হয়। গণতন্ত্র সকল মানুষকে সমান গুণসম্পন্ন মনে করে মানুষে মানুষে জন্মগত পার্থক্যের সত্যটিকে অস্বীকার করে। ব্যক্তিগত মননশীলতার পার্থক্য বা প্রতিভার স্বীকৃতি গণতন্ত্র প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া প্রতিভার মূল্য উপেক্ষিত হওয়ায় গণতন্ত্রের সভ্যতাও নিম্নস্তরের হয়।
(৭) রক্ষণশীলতার সমর্থক: গণতন্ত্রে প্রগতিশীল চিন্তাধারা অপেক্ষা রক্ষণশীলতা অধিকতর প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। অশিক্ষিত ও অম্ল জনগণ নতুন চিন্তাধারা বা ধ্যান-ধারণাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। নতুন চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, আবিষ্কারকে সাধারণ মানুষ অবিশ্বাসের চোখে দেখে। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় প্রগতিশীল পদ্ধতি বা ধারণার পরিবর্তে গতানুগতিকতাই প্রাধান্য লাভ করে।
(৮) স্থায়িত্বশীলতার অভাব: হেনরী মেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ক্ষণভঙ্গুর বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। জনগণ-পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন বিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সংঘাত শাসনব্যবস্থায় ঘন ঘন পরিবর্তনের সম্ভাবনা আহ্বান করে।
(৯) দলপ্রথার কুফল দেখা দেয়: দলপ্রথা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অঙ্গ। কিন্তু ক্ষমতালোভের মোহে রাজনৈতিক দলগুলি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তাছাড়া, নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর কার্যতঃ মুষ্টিমেয় দলনেতা সকল ক্ষমতা অধিকার করেন। দলীয় স্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করে যায়। সাধারণ কল্যাণ অপেক্ষা দলীয় স্বার্থ সিদ্ধি করবার প্রবণতা প্রাধান্য লাভ করে।
(১০) জাতীয় সংকটে উপযুক্ত নয়: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহুজনের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির জন্য দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। জাতীয় সংকট বা জরুরী অবস্থার সময়ে এই শ্লথগতি পদ্ধতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
◇ উপসংহার
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকাংশ যুক্তিযুক্ত নয় বলে অনেকে মনে করেন। বার্নসের মতে, বর্তমান যুগের প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত তা নিঃসংশয়ে দাবি করা যায় না। কিন্তু কোন শাসনব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। লর্ড ব্রাইস বলেছেন, “গণতন্ত্র হয়তো বিশ্ব-মানবের ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করতে পারে না, হয়তো শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত মনকে রাষ্ট্রের কাজে নিয়োগ করতে সক্ষম হয় নি, রাজনীতিকে দোষমুক্ত করতেও হয়তো বিফল হয়েছে; তথাপি অতীত শাসনব্যবস্থার তুলনায় গণতন্ত্র নিজ অধিকার সুপ্রমাণিত করেছে।” সুতরাং প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থার ত্রুটিগুলি দূর করে, শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে প্রথাকে সংকীর্ণতামুক্ত করে এবং বিশেষভাবে অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে যুগোপযোগী করে তুলতে পারলে শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।