যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলি দলের প্রভাব থাকে, কোনো দলই সুস্পষ্ট প্রাধান্য লাভ করে না, তাকে বহুদলীয় ব্যবস্থা বলে। ফ্রান্স, ইতালী, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে। বহুদলীয় ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধাগুলি হল:
বহুদলীয় ব্যবস্থার সুবিধা
(১) বিভিন্ন মতের যথাযথ প্রকাশ হয়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বলেন, গণতন্ত্রের যথার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সমস্ত মানুষের মতামত প্রকাশের উপযুক্ত সুযোগ ও প্রতিনিধিত্ব থাকা বিশেষ প্রয়োজন। আর্থার হোলকম্বের মতে, সমাজে মতবৈচিত্র্য ও বিশ্বাসের গভীরতা প্রধান হলে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা সার্থকভাবে জনমত প্রতিফলিত করতে পারে না। বহু-দলীয় ব্যবস্থাই একমাত্র সমাজে বিভিন্ন মতধারার উপযুক্ত প্রতিফলন সম্ভব করতে পারে। সুতরাং ইহা অধিকতর গণতান্ত্রিক।
(২) নির্বাচকগণের অধিক স্বাধীনতা থাকে: বহুদলীয় ব্যবস্থায় আইনসভা যথার্থ জনপ্রতিনিধি সভা হিসাবে সংগঠিত হতে পারে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের ফলে নির্বাচকগণের সম্মুখে অনেক বিকল্প থাকে এবং তাদের মনোনয়নের স্বাধীনতা বিস্তৃত হয়। র্যামজে মুরের মতে দুটি দলের মধ্যে নির্বাচকের পছন্দকে সীমাবদ্ধ রাখা অযৌক্তিক। বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নাগরিকদের পক্ষে মনোমত প্রার্থী বাছাই করবার অনেক বেশি সুযোগ ঘটে।
(৩) স্বৈরাচারী সম্ভাবনা থাকে না: বহুদলীয় ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার হতে গণতন্ত্রকে রক্ষা করে এবং নাগরিক স্বাধীনতা সম্ভব করে। এই ব্যবস্থায় কোন একটি দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবার সুযোগ কম থাকে। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারী হবার সম্ভাবনাও কম থাকে।
(৪) কায়েমী স্বার্থ গড়ে উঠতে পারে না: বহুদলীয় ব্যবস্থায় এককভাবে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে আধান্য বিস্তারের সম্ভাবনা কম থাকে। এর ফলে কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিশেষ গোষ্ঠীস্বার্থ বা কায়েমী স্বার্থের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের সম্ভাবনা কম থাকে। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ বা কায়েমী স্বার্থ শাসন- নীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয় না।
বহুদলীয় ব্যবস্থার অসুবিধা
(১) সরকারের স্থায়িত্বের অভাব: বহুদলীয় ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা প্রধান ত্রুটি হল যে, এটি স্থায়ী সরকারগঠনে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে কোন একটি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের সম্ভাবনা সকল সময়ে থাকে না। বিভিন্ন দলের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ নীতি ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে ‘সম্মিলিত সরকার’ (coalition Government) গঠিত হয়। শরিক দলগুলির মতাদর্শগত পার্থক্য স্বার্থের সংঘাত ও নিজ নিজ প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার গঠনের পথে অন্তরায়।
(২) শাসননীতির ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়: সরকারের অস্থায়িত্বের জন্য বহুদলীয় ব্যবস্থায় স্বার্থের অনুকূল নীতি ও কর্মসূচীর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় না। ফ্রান্সের তৃতীয় সাধারণতন্ত্রের ইতিহাসে এর যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। সরকারের দ্রুত পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকলে দীর্ঘমেয়াদী কোন নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
(৩) শক্তিশালী বিরোধী দলের সুযোগ কম থাকে: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম শর্ত হল শক্তিশালী ও সুসংগঠিত বিরোধী দলের অস্তিত্ব। বহুদলীয় রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শগত ও স্বার্থগত বিরোধ সুসংহত বিরোধী দল গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
(৪) সামাজিক শৃঙ্খলা ও ঐক্য-পরিপন্থী: বহুদলীয় ব্যবস্থা সমাজজীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে অকাম্য উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে থাকে। প্রাধান্য বিস্তারের জন্য কোন দল মিথ্যা প্রচার ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হয় না। মিথ্যা প্রচারে জনগণও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচনে অকাম্য উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং সমগ্র পরিবেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মার্কসবাদী লেখকগণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় বহু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করেন। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থের ধারক ও বাহক হিসাবে অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বাস্তব এবং স্বাভাবিক।