বিজয়নগর রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রামে বসবাস করতো এবং তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি উৎপাদন। এইভাবে গ্রামগুলি কৃষক ও ভূস্বামীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। অতীতকাল থেকেই এখানে কৃষিযোগ্য জমি গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে সময়ভিত্তিক বণ্টন করা হত। ছোট-বড় ভূস্বামী ছাড়াও ছিল অসংখ্য ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। এই ‘কৃষক সর্বহারা’ শ্রেণী ছিল কৃষি উৎপাদনের প্রধান শক্তি। তবে এদের অধিকাংশের অবস্থা ছিল ভূমিদাসদের সমতুল্য। সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন এই শ্রেণীর মানুষ নিজেদের অবস্থার রুপান্তর ঘটানোর কোন ক্ষমতাই ধরত না। কামার, কুমোর, তাঁতি ইত্যাদি ক্ষুদ্র কারিগরদের গ্রামে আটকে রাখার জন্য কিছু কিছু জমি চাষের অধিকার দেওয়া হত। নিম্নবর্গের গৃহভৃত্যদের কাজের বিনিময়েও কিছু জমি বরাদ্দ করা হত।
দৈনিক কৃষি-মজুরদের সাধারনত উৎপন্ন শস্যে মজুরী দেওয়া হত। বর্গা চাষ বিজয়নগরে জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত মঠ ও মন্দিরের জমিগুলি বর্গা বা ভাগচাষীদের মধ্যে বণ্টন করে চাষাবাদ করা হত। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের বর্গাচাষে কৃষক বা বর্গাদার জমির আংশিক মালিকানার অধিকারী হয়ে যেতেন।
খাদ্যশস্য ও ডাল জাতীয় শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি বিজয়নগরে ফুল, ফল ও অন্যান্য কাঁচা-আনাজের চাষ জনপ্রিয় ছিল। কালক্রমে বিভিন্ন অর্থকরী বাণিজ্যিক পণ্য যেমন তুলা, আখ ইত্যাদি চাষের দিকেও বিজয়নগরের কৃষকেরা নজর দেয়। বড় বড় বাগিচাগুলিতে পান, সুপারি, আদা, হলুদ, ও নানারকম ফল-ফুল চাষ করা হত। পর্যটক আব্দুর রজ্জাক বলেন, বিজয়নগরে গোলাপ ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্যের ছিল।
বিজয়নগরে জলসেচের ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। এজন্য নদী ও খালের উপর বাঁধ দিয়ে কৃষি জমিতে জলের যোগান দেওয়া হত। যে সব একালায় প্রাকৃতিক ভাবে জল যোগানের সুযোগ ছিল না, সেখানে জলাশয় খনন করে জমিতে জলসেচ দেওয়া হত। সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই সকল জলাশয় রক্ষাণাবেক্ষণে বিশেষ নজর রাখতেন। অনাবাদী জমিকে কৃষিজমিতে উন্নীত করার জন্য কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হত। এই সকল ক্ষেত্রে উদ্যোগী কৃষকদের করভার লাঘব করে কিংবা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে উৎসাহিত করা হত।
কৃষকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করত অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। তবে এজন্য কৃষকদের অধীন জমির বন্দোবস্তের শর্তাদি ও রাজস্ব আদায়কারী সংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধর্ম প্রতিষ্ঠান বা জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জমিতে চাষরত কৃষকদের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভাল ছিল। ভূস্বামী হিসেবে মঠ বা মন্দির কর্তৃপক্ষ অনেকবেশি সহনশীল ও উদার ছিলেন। উচ্চপদস্থ কর্মচারী বা অভিজাতদের মালিকানাধীন জমির কৃষকদের উপর করের বোঝা ছিল সাধারণ ভাবে নিপীড়ণমূলক। নায়ঙ্কারা ব্যবস্থা জোরালো হলে কৃষকেরা নায়কদের নির্ধারিত মূল্যে নগদ অর্থে শস্য কিনতে বাধ্য হত। এতে কৃষকদের অবস্থার দারুণ অবনতি ঘটে।
কৃষিকাজের পাশাপাশি গো-পালন ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন বিজয়নগর রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৃষিজমির বাইরে গো-চারণ ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা থাকত। মন্দির কর্তৃপক্ষের অধীনে বহু গবাদি পশু থাকত। বিভিন্ন মন্দিরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের জন্য জ্বালানী হিসেবে ঘি ব্যবহার করা হত। এছাড়া অভিজাত শ্রেণীর খাদ্য তালিকায় গব্য-ঘৃত ছিল অতি-আবশ্যিক একটি পদ। স্বভাবতই, গো-পালন বিজয়নগর রাজ্যে একটি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক বৃত্তি হিসেবে গন্য হত।
পর্যটক পায়েজের বিবরণ থেকে বিজয়নগর রাজ্যের কৃষি-জীবনের সার্বিক চিত্র পাওয়া সম্ভব। তিনি লিখেছেন, “এদেশে প্রচুর ধান, অন্যান্য শস্য, শিম-জাতীয় ফসল আমাদের দেশে হয়না এমন সব শস্য উৎপন্ন হয়; কার্পাসের প্রচুর চাষ হয়। এদেশে অসংখ্য গ্রাম, শহর ও বড় বড় নগর আছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে রাজাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। বেশিসংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনার জন্য এবং অনাবাদী জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্য সরকারের তরফে নানা ব্যবস্থা গৃহীত হয়।”