মুঘল সম্রাটরা স্থাপত্য শিল্পে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। মুঘল স্থাপত্য ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। মুঘল সম্রাটরা নতুন কোনো শিল্পশৈলীর উদ্ধাবক ছিলেন না। মুঘল সম্রাটরা বিভিন্ন সৌধ নির্মাণের ক্ষেত্রে পারসিক স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করেন। হুমায়ুন ও আকবরের শাসনকালে স্থাপত্যে পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আকবর পারসিক শিল্পশৈলীর পাশাপাশি ভারতে শিল্পকর্মে ভারতীয় ঐতিহ্যকে পরিস্ফুট করতে বেশি আন্তরিক ছিলেন। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের সময় পারসিক শিল্পরীতি হ্রাস পেয়েছিল এবং প্রকৃত অর্থে ভারতীয় শিল্পধারা নতুনভাবে জেগে উঠেছিল।
বাবর, হুমায়ুন ও শের শাহের আমলে স্থাপত্য
বাবর ভারতীয় শিল্পের অনুরাগী ছিলেন না। তিনি আত্মজীবনীতে ভারতীয় শিল্পীদের দৈন্য সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্য এবং শিল্পীদের দক্ষতা সম্পর্কে তাঁর উন্নাসিকতা ছিল। তিনি রুমী বা কনস্টান্টিনোপল থেকে শিল্পী এনে পাথর কেটে প্রাসাদ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। পানিপথের কাবুল রাগ মসজিদ ও সম্বলের জামা মসজিদ বাবরের স্থাপত্যের একমাত্র নিদর্শন।
হুমায়ুনের আমলে বিশেষ কোন সৌধ তৈরি হয় নি। হুমায়ুন “দীনপানাহ” নামে এক নতুন নগরী নির্মাণের সুত্রপাত করেন। “দীনপানাহ” শব্দের অর্থ ‘জগতের আশ্রয়’। পাঞ্জাবের হিসার জেলার ফতেয়াবাদে হুমায়ুনের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ রয়েছে।
শূর শাসক শের শাহ সাসারাম ও দিল্লিতে অপূর্ব সৌধ নির্মাণ করেন। শের শাহের স্থাপত্যের শৈলী বিহারের সাসারামে তাঁর সমাধি সৌধে দেখা যায়। শের শাহের স্থাপত্যগুলি সুলতানি যুগের ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্য রীতির সঙ্গে মুঘল যুগের ইন্দো-পারসিক শৈলীর সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। শের শাহের দিল্লি স্থাপত্যের মধ্যে পুরান কিল্লা বিখ্যাত। এছাড়া শের শাহ দিল্লিতে ‘কিলা-ই-কোহনা’ মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটি দৈর্ঘ্য ১৩৮, প্রস্থে ৫৫ এবং উচ্চতায় ৬০ ফিট।
আকবরের আমলে স্থাপত্য
আকবর ছিলেন মুঘল স্থাপত্য রীতির প্রতিষ্ঠাতা। আকবরের আমল থেকে ইন্দো-পারসিক রীতির মিশ্রণে স্থাপত্যের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। আকবরের আমলের সর্বপ্রথম সৌধ ছিল হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের বিধবা হাজী বেগমের উৎসাহে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের সমাধি সৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। হুমায়ুনের সমাধির বৈশিষ্ট্য ছিল চার কোণে চারটি চূড়া ও মাঝখানে গম্বুজ। সৌধটি ২২ ফুট উঁচু বেদীর ওপর নির্মিত হয়। সৌধটির চূড়ার গম্বুজ মার্বেল পাথরে তৈরি। সৌধের ভেতরের কক্ষগুলির মাঝের কক্ষটিতে সম্রাটের সমাধি অবস্থিত। সৌধটি আয়তক্ষেত্রের আকৃতি এবং চতুর্দিকে প্রশস্ত উদ্যান।
আগ্রা দুর্গের জাহাঙ্গীরী মহল নির্মাণে বিশুদ্ধ হিন্দু রীতি অনুসরণ করা হয়। ফতেপুর সিক্রির সৌধগুলি নির্মাণে ইন্দো-পারসিক রীতি নেওয়া হয়। বহু সৌধে হিন্দু রীতির ছাপ দেখা যায়। আকবর পরিকল্পিতভাবে কাশিম খাঁর নেতৃত্বে ফতেপুর সিক্রিতে রাজধানী শহরটি বানিয়েছিলেন। এই শহরটি পনের বছর ধরে নির্মাণ করেন। দরবেশ সেলিম চিস্তির সমাধি ঘিরে ফতেপুর সিক্রি গড়ে উঠেছিল। এই শহরটি একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত, নিচে ছিল সরোবর। ‘ফতেপুর’ শব্দের অর্থ ‘বিজয়নগরী’। ফতেপুর সিক্রির জামি মসজিদ বিশেষ বিখ্যাত সৌধ। এই জামি মসজিদ তিনটি গম্বুজ দ্বারা সুশোভিত।
আকবর সেকেন্দ্রাতে নিজের সমাধি সৌধ নির্মাণ আরম্ভ করেন। এছাড়া ফতেপুর সিক্রিতে বীরবলের গৃহ, অম্বরের রাজা মানসিংহের গৃহ, পাঁচমহল, খাসবাগ, দেওয়ান-ই-খাস উল্লেখ্য। পাঁচমহল বাড়িটি ছিল পাঁচতলার, পিলারের ওপর স্থাপিত। মুঘল স্থাপত্য রীতির শ্রেষ্ঠ অবদান হল দেওয়ান-ই-খাস, বিশাল হলের মধ্যে থামগুলি সম্রাটের আসনকে কখনো আড়াল করে না।
আকবর দিল্লির পশ্চিম দিকের বিখ্যাত দরওয়াজা হাতী দরওয়াজা নির্মাণ করেন। আকবরের অন্যতম বিখ্যাত সৌধ ছিল আগ্রা দুর্গ। মহম্মদ কাশিম খাঁর পরিচালনায় আগ্রা দুর্গ নির্মাণ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। যমুনা নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর আগ্রা দুর্গের নির্মাণে গুজরাটী স্থাপত্য শৈলী প্রয়োগ করেন। আবুল ফজল লিখেছেন যে, আকবর আগ্রা দুর্গের মধ্যে পাঁচশ বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়িগুলি ছিল লাল পাথরের তৈরি এবং রীতি ছিল বাংলা ও গুজরাটি। এইভাবে পারসিক স্থাপত্যের ভারতীয়করণ ঘটে।
জাহাঙ্গীরের আমলে স্থাপত্য
সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্থাপত্যের দিকে কোনো আগ্রহ ছিল না। আকবরের অসমাপ্ত সেকেন্দ্রার সমাধি সৌধের কাজ নুরজাহান বেগমের নির্দেশে শেষ হয়। সেকেন্দ্রার সমাধিটি ৩০০ বর্গ ফিট এবং ৩০ ফিট উঁচু। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের সর্বপ্রথম লাল পাথরের স্থলে মর্মর পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। তিনি মোজাইকের ব্যবহার চালু করেন। জাহাঙ্গীর লাহোরে তাঁর প্রাসাদ ও সমাধি নির্মাণ করেন। ৩২৫ বর্গফিট ও ২২ ফিট উচ্চতার সমাধিতে ১০০ ফিট উঁচু একটি মিনার শোভা বর্ধন করছে। নূরজাহানের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল আগ্রায় তাঁর পিতা ইতিমাদ উদদৌলার সমাধি সৌধ নির্মাণ। সমগ্র সৌধটি ছিল শ্বেতপাথরে তৈরি। এই সৌধের অভ্যন্তরীণ কক্ষের দেওয়ালগুলি মহার্ঘ মোজাইক দ্বারা শোভিত। এই রীতিকে “ঝারোখ” রীতি বলা হয়। এই আয়তাকার আটকোণা বিশিষ্ট সমাধি সৌধ অতীব সুন্দর।
শাহজাহানের আমলে স্থাপত্য
শাহজাহানের রাজত্বকাল ছিল মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ। তিনি আগ্রা দুর্গ মার্বেল পাথরের দ্বারা তৈরি করেন। তিনি দিল্লি নগরীতে রাজধানী স্থানান্তর করে দিল্লিকে সুসজ্জিত করেন। শাহজাহান দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নামে শহর তৈরি করেন। তিনি দিল্লিতে লালকেল্লা দুর্গ নির্মাণ করেন। আগ্রা দুর্গের অনুকরণে লালকেল্লা তৈরি হয়। দেওয়ানী খাসের থাম ও গম্বুজের অলঙ্করণ এবং পাথরের সঙ্গে সোনা ও রূপার কাজ শাহজাহানের নতুন স্থাপত্য শৈলীর পরিচয় দেয়। দেওয়ানী আমের সিংহাসন এবং গম্বুজের আকার এমনভাবে করা হয়েছে যে, সিংহাসনে সম্রাট সামান্য জোরে কথা বল্লে গোটা আমদরবার ও নিকটস্থ অঙ্গনে দাঁড়ান লোকেদের কানে স্পষ্টভাবে পৌঁছাত।
দেওয়ানী আমের মাঝখানে ছিল বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন। শিল্পী বেবাদল খাঁ ময়ূর সিংহাসন নির্মাণ করেন। এই সিংহাসনের নিচে রত্নখচিত ময়ূর বাহন হিসাবে সিংহাসনকে পিঠে করে রাখত। সিংহাসনের মাথায় ছিল হীরা ও রত্নখচিত ছাতা। পারসিক সম্রাট নাদির শাহ দিল্লি লুঠ করে ময়ূর সিংহাসন নিয়ে যান। তারপর ময়ূর সিংহাসনের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। লালকেল্লার ভেতরে আছে বিখ্যাত মোতি মসজিদ। এই মসজিদটি শাহজাহানের শ্রেষ্ঠ সৌধগুলির অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। শাহজাহান লালকেল্লার বাইরে জামি মসজিদ তৈরি করেন। এই মসজিদের বিশালতা ও জাঁকজমক বিখ্যাত। লাল পাথরে নির্মিত দিল্লির জামি মসজিদ হল সবচেয়ে বড় মসজিদ। অনেকগুলি গম্বুজ, মিনার ও বিশাল দরজা দিয়ে মসজিদটিকে সাজানো হয়েছিল।
শাহজাহানের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি হল প্রিয় পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিসৌধ আগ্রার তাজমহল। তাজমহলের বিশেষ সৌন্দর্য হল বিশাল গম্বুজ ও চারটি মিনার। সাদা মার্বেল পাথরে সমগ্র সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাজমহলে “ঝারোখ” শৈলীর স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন দেখা যায়। প্রায় ২২ বছর ধরে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তাজমহল তৈরি করা হয়। ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে বেগম মমতাজ মহলের সমাধির ওপর তাজমহল স্মৃতিসৌধ নির্মাণে ইরানী, তুর্কী ও ভারতীয় শিল্পীদের নিয়োগ করা হয়। তাজমহলের প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ ঈসা। তাজের নির্মাণ শৈলী ও অভ্যন্তরীণ গঠনে পুরা প্রাচ্যদেশিয় মেজাজ ও ভাব দেখা যায়। আগ্রার অধিবাসী ওস্তাদ ঈসা তাজমহলের নক্সা করেন। কাশ্মীরবাসী রনমল তাজমহলের উদ্যানের নক্সা করেন। তাজমহলের পিয়ে ত্রা দুরা অলঙ্করণের কাজ করেন মূলতান ও কনৌজ থেকে আগত হিন্দু শিল্পী। তাজমহলের দেওয়ালে কোরানের বাণী খোদাই করেন কান্দাহারের অধিবাসী আমানত খাঁ মিরাজী। তাজমহলের গম্বুজের কাজ করেন বাইজানটিয়ান থেকে আগত ইসমাইল খাঁ রুমী। সমগ্র সৌধটি প্রাচ্যদেশিয় স্থপতির দ্বারা নির্মিত।
ঔরঙ্গজেবের আমলে স্থাপত্য
ঔরঙ্গজেব স্থাপত্য শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্র, স্থাপত্য কোন কিছুই পছন্দ করতেন না। তাঁকে নিরন্তর বিদ্রোহ দমন ও যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। তাঁর আমলে রাজকোষের আয় কমতে থাকে। এজন্য ঔরঙ্গজেবের আমলে বেশি প্রাসাদ-অট্টালিকা নির্মিত হয় নি। তিনি লাহোরে পাদশাহী মসজিদ, বারাণসীর মসজিদ ও দিল্লিতে অনাড়ম্বর মসজিদ তৈরি করেন। ড. সরস্বতীর মতে, দিল্লির মসজিদটি ছিল দিল্লি দুর্গের ভিতরে মোতি মসজিদ। ঔরঙ্গজেবের আমল থেকে মুঘল স্থাপত্য শিল্প অবনতি ঘটে। দক্ষিণে ঔরঙ্গাবাদে ঔরঙ্গজেবের মধ্যম পুত্র আজম শাহ তাঁর মাতা ঔরঙ্গজেব-পত্নী রাবিয়া-উদ-দুরাণীর স্মৃতিতে তাজমহলের অনুকরণে সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন।
মুঘল যুগের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
মুঘল যুগের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হল গম্বুজের ব্যবহার, অর্থাৎ বিরাট বিরাট থামওয়ালা প্রাসাদ। মুঘল স্থাপত্যগুলিতে গম্বুজ, থামের কাজ প্রভৃতিতে পারসিক প্রভাব ছিল। মুঘল যুগের বহু স্থাপত্য কর্মে বিদেশি ও স্বতন্ত্র মুসলিম শিল্পরীতির প্রভাব স্পষ্ট রয়েছে। মুঘল স্থাপত্যের মূল শিকড় ভারতীয় প্রথায় গাঁথা ছিল। মুঘল স্থাপত্যকলা পারসিক ও ভারতীয় ধারার সংমিশ্রণে গড়া হয়।
মুঘল যুগের স্থাপত্য ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতির মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। হিন্দু, মুসলিম
মুঘল সম্রাটরা চমৎকার দরওয়াজা, দুর্গ, সমাধি সৌধ, মসজিদ, প্রাসাদ, এবং বাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন।
মুঘল স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল বড় খিলানযুক্ত দরজার ব্যবহার।
মুঘল স্থাপত্য চমৎকার অলঙ্করণে সজ্জিত ছিল। মোজাইকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গম্বুজে অলঙ্করণ এবং দেওয়ালে কোরানের বাণী খোদাই করা হত।
মুঘল স্থাপত্য লাল পাথর, মর্মর পাথর এবং সাদা মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হত। তাজমহল হল সাদা মার্বেল ব্যবহারের উদাহরণ।
মুঘল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ভারত, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে দেখতে পাওয়া যায়।