ষোড়শ শতকে মুঘল ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার (Banking System of Mughal India) প্রচলন হয়। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ, ফ্যাক্টরী রেকর্ডস ও সমসাময়িক পার্শি ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে মুঘল ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনেক কিছু জানা যায়। ষোড়শ শতকে ভারতে বিনিময় প্রথা (Exchange of Money), বিল পদ্ধতির মাধ্যমে টাকা পাঠানো প্রচলিত ছিল। মুঘল যুগে দেশের সমস্ত বাণিজ্য ও শিল্প ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থা অর্থাৎ ঋণদাতা, মহাজন, মুদ্রা বিনিময়কারী স্রফ, সাহুকার ইত্যাদি যুক্ত ছিল।
মুঘল ভারতের অধিকাংশ গ্রামে ছোটো ব্যাংকার ছিল। এদের ‘স্রফ’ বলা হত। মুদ্রা বিনিময়, টাকা পাঠানো, হুন্ডির ব্যবস্থা অথবা হুন্ডির বদলে অর্থ প্রদান ইত্যাদি সমস্ত আর্থিক অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকারের কাজ স্রফকে করতে হত। স্রফরা নগদ টাকা বা উৎপন্ন দ্রব্য আমানত হিসাবে রেখে ব্যবসায়ীকে উচ্চ সুদে ধার দিত। অফরা সুদের বিনিময়ে টাকা জমা দিত এবং চড়া সুদে টাকা ধার দিত। তাঁরা আধুনিক ব্যাংকের মতই কাজ করত। স্রফরা টাকা আমানত রেখে সুদ দিত, সুদের হার ছিল বার্ষিক ৭.৫ শতাংশ। স্রফরা প্রধানত ব্যবসার জন্য অর্থ ঋণ দিত ও অল্পদিনের জন্য ঋণ দিত।
ঋণের ব্যবসা কোন নির্দ্দিষ্ট সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ছিল না। মহাজনদের মধ্যে ধনীরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দিত। মুঘল রাজপুরুষরা মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করতেন। রাজস্ব আদায় কম হলে বা যুদ্ধ-বিগ্রহ বাধলে মহাজনরা টাকা ধার দিত। পাইকারী ব্যবসায়ী, মহাজন ও সাহুকাররা টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসা করত। এরা সমাজের নিম্নশ্রেণিকে অতি চড়া সুদে টাকা ধার দিত। মহাজনরা প্রধানত টাকা জমা রাখত এবং টাকা বদলের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। পাঞ্জাবের শস্য ব্যবসায়ী, বাংলার সন্ন্যাসী, জমিদারের অধীন ধনী পেশাদার সুদের কারবারী অতি উচ্চসুদে টাকা ধার দিত। বাংলার জগৎ শেঠরা মহাজনী, বাণিজ্য ও স্রফের কাজ করে বহু অর্থের মালিক হয়েছিল।
মুঘল যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যে নগদ অর্থের পরিবর্তে হুণ্ডি প্রথা প্রচলিত ছিল। ব্যাংকারের কাছে গচ্ছিত টাকার বিনিময়ে হুণ্ডির (Bill of Exchange) মাধ্যমে ব্যবসাদাররা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে বেসরকারি ব্যক্তি ইউরোপীয় কুঠিয়াল এবং এমনকি সরকারি প্রশাসন পর্যন্ত হুণ্ডি ব্যবহার করত। মুঘল যুগে ব্যবহৃত হুণ্ডি আধুনিক যুগে ব্যাঙ্ক ড্রাফট বা চেকের মত ছিল। নগদ টাকার পরিবর্তে হুণ্ডি ব্যবহৃত হত এবং একজনের হুণ্ডি অন্য জনকে দেওয়া যেত। আধুনিক ব্যাংকের মতো এই কাজের বিনিময়ে টাকার একটা অংশ তারা বাটা হিসাবে নিত। মাল পাঠানোর দুরত্বের ওপর বিনিময়ের হার নির্ভর করত। হুণ্ডি বিক্রয়যোগ্য ছিল। মোগল যুগে সারা দেশে বণিকদের মধ্যে হুন্ডি প্রথার প্রচলন ছিল। মুঘল যুগে চার ধরনের হুণ্ডি ছিল—(১) দর্শনী হুণ্ডি, (২) মিতি হুণ্ডি, (৩) শা-জগহুণ্ডি, (৪) জোখামি হুন্ডি।
আকবর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলায় উৎসাহ দিতেন। জাহাঙ্গীরের অধীনে ব্যাংক ব্যবসার প্রসার ঘটেছিল। মুঘল ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বীমার ব্যবসা বেড়েছিল। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে সাথে স্রফরা বীমা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হত। স্রফরা মাল চলাচলের জন্য বীমা করত। বীমার খরচ অল্প ছিল। জাহাঙ্গীরের সময় ব্যাংকের বিখ্যাত মালিক ছিলেন সুরাটের বীরজি ভোরা, করমন্ডল উপকূলের মল্লয় ও মালাবারের শেঠি। অধিকাংশ নীল ব্যবসাদার ছিলেন ব্যাংকের মালিক। মুঘলদের অধীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ‘কোঠী’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে একজন ধনী ব্যাংকার ছিলেন মানিক চাঁদ। ঔরঙ্গজেব তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘শেঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। শেঠ মানিক চাঁদের পরিবারের সবাই ব্যাংকার ছিলেন। বাংলার স্বাধীন নবাবী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শেঠ পরিবারের উন্নতির সূচনা হয়। ১৭২২ খ্রিঃ বাদশাহ মহম্মদ শাহ শেঠ পরিবারের কাজকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে ফতে চাঁদকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি দেন। ১৭১৭ খ্রিঃ থেকে শেঠ পরিবার বাংলার টাকশাল পরিচালনা এবং মুদ্রা ব্যবস্থা ও মুদ্রা বিনিময় করার অধিকার পায়। আধুনিক স্টেট ব্যাংক যে কাজ করে শেঠ পরিবার সেই কাজ করত।
বাংলার নবাবদের সঙ্গে শেঠ পরিবারের ভাল সম্পর্ক ছিল। এজন্য তারা মুদ্রা ব্যবস্থার সর্বময় ক্ষমতা পায়। মীরকাশিমের আমল থেকে নবাবদের সঙ্গে শেঠ পরিবারের সম্পর্ক খারাপ হয়। মীরকাশিম শেঠদের ইংরেজদের চর বলে সন্দেহ করতেন। ১৭৬৫ খ্রিঃ থেকেই কোম্পানির সঙ্গে শেঠ পরিবারের সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। লর্ড ক্লাইভ শেঠ পরিবারের কাজকর্মের সমালোচনা করেন। প্রথমে নবাব ও পরে কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে জগৎ শেঠদের অবনতি ঘটে। মীরকাশিম শেঠদের অনেক টাকা কেড়ে নেয়। তিনি শেঠদের দুই ভ্রাতাকে হত্যা করেন এবং কয়েকজনকে বন্দী করেন।
কলকাতায় টাকশাল স্থাপিত হওয়ায় মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর শেঠদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ লোপ পায়। ওয়ারেন হেস্টিংস মুর্শিদাবাদের টাকশাল বন্ধ করায় শেঠদের ক্ষতি হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানির হাতে রাজস্ব থেকে টাকা আসায় শেঠদের কাছে কোম্পানি সুদে টাকা ধার নেওয়া বন্ধ করে। ওয়ারেন হেস্টিংস সরকারি ট্রেজারি মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আনলে শেঠ পরিবার সরকারের ব্যাঙ্কারের দায়িত্ব হারায়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে শেঠদের কুঠীগুলি রাজনৈতিক গোলযোগের ফলে বন্ধ হয়ে যায়। শেঠ পরিবার নবাবী আমলে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করত। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা সকল প্রকার বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করায় শেঠদের ব্যবসা নষ্ট হয়। এইভাবে মুঘল যুগে বাংলায় গড়ে ওঠা ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়।