নাগরিক বলতে সাধারণতঃ বোঝায় নগরবাসী বা শহরের বাসিন্দা।ভারতের প্রাচীন গ্রন্থে ও প্রাচীন গ্রীক গ্রন্থে নাগরিকত্ব সম্বন্দ্বে আলোচনা আছে। জন-সমষ্টি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু সমস্ত জন-সমষ্টিকে নাগরিক বলা হয় না। কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লী প্রভৃতি নগরে যারা বাস করে তাদেরকে এইসব নগরের নাগরিক বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিক শব্দের অর্থ “রাষ্ট্র সংস্থার সদস্য”। নাগরিক শব্দটির ব্যবহার গ্রীকদের নগর রাষ্ট্রের আলোচনায় পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে যাদের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রনৈতিক কার্যকলাপে যোগদান করবার যোগ্যতা ও বিশ্রামের জন্য প্রচুর সময় আছে তাদেরকেই নাগরিক বলে অভিহিত করা হত। সমাজের অবশিষ্টাংশ মানুষ ও ক্রীতদাস প্রভৃতিকে নাগরিক বলা হত না।
বর্তমানে নাগরিক সম্মন্ধে ধারণা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে বিশাল রাষ্ট্রে যারা স্থায়িভাবে বসবাস করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শ’ন করে তারাই নাগরিক। বর্তমানে নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতকগুলি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আবার বর্তমান রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছ থেকে সক্রিয়ভাবে কোন কর্তব্য পালনের দাবি করে না, কিন্তু নাগরিককে রাষ্ট্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নতিতে সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকিতে হয়। নাগরিকের যে প্রতিভা ও বুদ্ধি আছে তা সর্বসাধারণের কল্যাণে নিয়োগ করা, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির মাধ্যমে নিজের জীবনকে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করা বিধেয় বলে মনে করা হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেন যে, ‘নাগরিকত্ব হলো জনগণের কল্যাণে ব্যক্তির দ্বারা মার্জিত বুদ্ধির প্রয়োগ’।
নাগরিকতার অর্থ হলো ব্যক্তির মধ্যে কতকগুলি গুণের সমাবেশ। আবার শুধুমাত্র গুণের সমাবেশ হলেই চলবে না, সেই গুণী ব্যক্তিকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের মাধ্যমে সমষ্টিগত স্বার্থের জন্য তার গুণাবলীকে প্রয়োগ করতে হবে।
বর্তমান রাষ্ট্রে দেখা যায় রাষ্ট্রের সমগ্র অধিবাসীই নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে না। বর্তমানে রাষ্ট্রের অধিবাসীকে সাধারণতঃ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়; যথা—(১) নাগরিক, (২) সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ নাগরিক এবং (৩) বিদেশী।
(১) নাগরিক: রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে একটা অংশ নাগরিক। নাগরিক সভ্য মানুষ হিসাবে বাঁচবার অধিকার, নির্বাচনে ভোট দেবার অধিকার, নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দিতা করবার অধিকার এবং নির্বাচনমুলক পদ অধিকার করার সুযোগের অধিকার ভোগ করে। রাষ্ট্রের অন্যান্য অধিবাসীরা তা করে না। নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য জানায় এবং নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব পালন করে।
(২) সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ নাগরিক: রাষ্ট্রে নাগরিক ছাড়াও আরও এক প্রকার লোকের সন্ধান পাওয়া যায় যারা নাগরিকের মতোই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে এবং রাষ্ট্রের আইনকানুন মেনে চলে, তথাপিও তারা নাগরিকত্ব পায় না। যেমন— আঠারো বছর বয়ষ্ক না হলে ভারতের কোন স্ত্রী-পুরুষই পূর্ণ নাগরিকত্ব পায় না। রাষ্ট্রের স্থায়ী অধিবাসীদের মধ্যে যারা ভোটাধিকার পায় তারা পূর্ণ নাগরিক আর যারা ভোটাধিকার পায় না তারা অসম্পূর্ণ নাগরিক।রাষ্ট্রের কাঠামোও নাগরিকত্ব স্থির করে। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব বিভক্ত হতে পারে। যেমন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বি-নাগরিকত্ব (Dual Citizenship) স্বীকৃত হয়েছে। অর্থ্যাৎ ‘একই নাগরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে পারে আবার যে অঙ্গ রাজ্যে সে বাস করে সেই অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্ব পেতে পারে।
(৩) বিদেশী: রাষ্ট্রে নাগরিক ও অসম্পূর্ণ নাগরিক ছাড়াও আরও এক প্রকার লোকের সন্ধান পাওয়া যায় যারা বিদেশী নামে পরিচিত। অন্য কোন রাষ্ট্রের নাগরিক যখন সাময়িক ভাবে কোন রাষ্ট্রে বাস করে তখন তাকে বিদেশী বলে গণ্য করা হয়। বিদেশীরা তাদের নিজেদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। বিদেশী ও অসম্পূর্ণ নাগরিক উভয়েই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তথাপি বিদেশী ও অসম্পূর্ণ নাগরিক এক নয়। বিদেশীরা ভিন্নদেশের লোক আর অসম্পূর্ণ নাগরিক দেশের লোক।
নাগরিকত্ব অর্জনের পদ্ধতি (Methods of Acquisition of Citizenship)
সাধারণতঃ নাগরিকত্ব অর্জনের দুটি পদ্ধতি আছে; যথা—(১) জন্মসূত্র এবং (২) অনুমোদন সূত্র। আবার জন্মসূত্র অনুসারে নাগরিকত্ব অর্জনের দুটি পদ্ধতি আছে; যথা—(ক) জন্মনীতি (Jus sanguinis) এবং (খ) জন্মস্থান নীতি (Jus soli or loci)।
(১) জন্মসূত্র: (ক) জন্মনীতি অনুসারে শিশু যে রাষ্ট্রেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সে তার পিতার নাগরিকত্ব পাবে আর (খ) জন্মস্থাননীতি অনুসারে শিশু যে রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করবে সে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে পিতা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয় আর তার সন্তান যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করে তা হলে উক্ত সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পিতা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয় আর তার সন্তান যদি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করে তা হলে উক্ত সন্তান ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাবে।
জন্মনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রাধান্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ নাগরিকেরা সন্তান যে রাষ্ট্রেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন তার উপর রাষ্ট্রের প্রাধান্য থাকবে। আর জন্মস্থান নীতির ক্ষেত্রে ভূমিগত প্রাধান্য আরোপ করা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সকল ব্যক্তির উপর এমনকি বিদেশি সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার উপর রাষ্ট্রের প্রাধান্য বর্তাবে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোন উড়োজাহাজ বা জাহাজের মালিক যদি ইংল্যান্ডের হয় এবং সেই উড়ো জাহাজ বা জাহাজে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের একটি সন্তান জম্মায় তবে সে সেই উড়ো জাহাজ বা জাহাজের মালিকের দেশের অর্থাৎ ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাবে। এইরূপ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাকে জন্মনীতি অনুসারে উক্ত সন্তানকে নাগরিকত্ব দিবে আর ইংল্যান্ডে তার জন্মস্থান নীতি অনুসারে উক্ত সন্তানকে নাগরিকত্ব দিবে। একই সময়ে একই ব্যক্তি দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না। এইরূপ দ্বিজাতি তত্ত্বের ফলে সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার নাগরিকত্ব স্থির করা কঠিন হইয়া পড়ে।
(২) অনুমোদন: অনুমোদন শব্দটি দুইভাবে ব্যবহৃত হয়; যথা—(ক) ব্যাপক অর্থে এবং (খ) সংকীর্ণ অর্থে। ব্যাপক অর্থে অনুমোদন বলতে বোঝায় বৈধতা (Legitimation), বিবাহ, সৈনাবাহিনীতে যোগদান, স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় করা, সরকারী চাকুরি গ্রহণ প্রভৃতি উপায়ে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা। আর সংকীর্ণ অর্থ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রনির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে কাউকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ভারত ও ইংল্যান্ডে অনুমোদন কথাব অর্থ বোঝায় রাষ্ট্রের শর্তসাপেক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিকত্ব প্রদান। ভারতে কোন বিদেশীকে নাগরিকত্ব পেতে হলে আবেদন করতে হয়। ব্যাপক অর্থে অনুমোদন দেবার জন্য আবেদন করতে হয় না। কিন্তু সংকীর্ণ অর্থে অনুমোদনের জন্য নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষ আবেদন করতে হয়। এই শর্তগুলি হল—
- স্থায়ী বাসিন্দার শর্ত (Lex domicili), অর্থাৎ যে নাগরিকত্ব পেতে চায় তাকে নির্দিষ্ট সময় রাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে;
- চিরকাল বসবাস করবার অঙ্গীকার ও কার্যের মাধ্যমে ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে;
- ভারত ও ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সচ্চরিত হইতে হবে;
- ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে ইংরাজি ভাষা, ভারতের ক্ষেত্রে সংবিধানের উল্লিখিত ২২টি ভাষার মধ্যে যে কোন একটিতে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা চাই।
অনুমোদনের দ্বারা নাগরিকত্ব অর্জন পূর্ণ (perfect) বা অসম্পূর্ণ (imperfect) দুইই হতে পারে। পূর্ণ নাগরিক কতকগুলি রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে আর অসম্পূর্ণ নাগরিক তা করে না। এমতবস্থায় ভারত, ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশের অধিবাসীদের একযোগে নাগরিকত্ব প্রদান করার নীতিও উল্লেখিত দেশগুলিতে প্রচলিত আছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সকল অনুমোদিত নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার অনেক দেশে ভোগ করিতে পারে না। যেমন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদনপ্রাপ্ত নাগরিক রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে পারে না। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাগরিকতা প্রাপ্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ধার্য করার ফলে জাতিবিদ্বেষ ও আন্তর্জাতিক বিরোধ দেখা দিয়েছে।
ভারতের নাগরিকত্ব অর্জনের পদ্ধতি
ভারতের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের 5-11 নম্বর ধারাগুলিতে নাগরিকত্ব সম্পর্কে সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার উল্লেখ আছে। সংবিধানের 11 নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্বের নিয়মকানুন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টকে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয পার্লামেন্ট আইন পাস করে নাগরিকত্ব সম্পর্কে যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
(১) (ক) সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে নাগরিকত্ব অর্জন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, জন্মস্থান ও স্থায়ী বসবাসের সূত্রে নাগরিকত্ব অর্জন করা যাবে। অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী অথবা তার পরবর্তী সময়ে ভারতে জন্মগ্রহণকারী সকল ব্যক্তি এবং ভারতে স্থায়ী বসবাসকারী সকল ব্যক্তি নাগরিকত্ব অর্জন করবে।
(খ) স্থায়ী বসবাসকারীদের মধ্যে যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেনি তাদের পিতা বা মাতা যদি ভারতে জমগ্রহণ করে থাকে তা হলে সংবিধান প্রবর্তিত হবার সময় তারা নাগরিকত্ব অর্জন করবে।
(গ) যারা সংবিধান প্রবর্তিত হবার ৫ বৎসর পূর্ব থেকে ভারতে বসবাস করে আসছে তারা যদি ভারতে স্থায়ী বাসিন্দা হয় তবে তারাও ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভারতে জন্ম বা পিতা বা মাতার ভারতে জন্ম অথবা সংবিধান চালু হবার ৫ বৎসর পূর্ব থেকে ভারতে বসবাস করলেই ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করা যাবে না। এর সাথে একটি শর্ত পূরণ করতে হবে, তা হল স্থায়ীভাবে বসবাসের শর্ত। বাসিন্দার অভিপ্রায়ের দ্বারা বাসিন্দার স্থায়ী বসতি কোথায় তা নির্ণয় করতে হবে। বাসিন্দার অভিপ্রায় জানতে পারা যায় বাসিন্দার গতিবিধি, জমিজমা ক্রয়, ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা, নিজ বাসগৃহ নির্মাণ প্রভৃতি থেকে। অতএব যারা ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে চাই তারা অভিপ্রায়গুলিকে কাজে পরিণত করবে এবং নাগরিকত্ব পাবে।
(২) পাকিস্থান থেকে আগতদের নাগরিকত্ব: স্বাধীনতা অর্জন করবার সময় ভারতবর্ষ দুইভাগে বিভক্ত হয়। এক ভাগের নাম হয় ভারত আর অপর ভাগের নাম হয় পাকিস্তান। স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর যারা পাকিস্তানে বসবাস করা নিরাপদ মনে করেনি তারা পাকিস্তান পরিত্যাগ করে ভারতে চলে এসেছিল। পাকিস্তান থেকে আগত ব্যক্তিবর্গকে নাগরিকত্ব প্রদান সম্পর্কে সংবিধান অনুসাবে ঠিক হয় যে, যারা ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের আগে ভারতে এসেছে তারা নিজে বা তাহাদের পিতা বা পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ, মাতামহীর মধ্যে কেহ যদি অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকে এবং তারা যদি ভারতে আসবার পর সাধারণভাবে ভারতে বাস করে থাকে তবে তারা ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী ভারতের নাগরিক অধিকার অর্জন করবে।
এ ছাড়া ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই বা তার পরে যারা পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছে তাদের জন্য ব্যবস্থা হয় যে, এই শ্রেণীর ব্যক্তিগণ যদি সংবিধান প্রবর্তিত হবার পূর্বে ভারত ডোমিনিয়নের সরকারের নিকট আবেদন করে ভারতের সংবিধান প্রবর্তনের তারিখে ভারতের নাগরিত্ব অর্জন করে। অবশ্য, সরকারের নিকট আবেদন করবার একটি শর্ত ছিল, তা হল নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবার অব্যবহিত পূর্বে আবেদনকারীকে ৬ মাস ভারতে বসবাস করিতে হবে। এর অর্থ ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী ৬ মাস পূর্বে পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতে হবে। কিন্তু এইসময়ের পরেও অনেক লোক পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসে। ফলে তাদের জন্য পার্লামেন্টে ১৯৫৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব আইন পাস হয়।
ধারায় বিদেশে ভারতীয় বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, সক ব্যক্তি নিজে অথবা যাহাদের পিতা বা মাতা বা পিতামহ বা মাতাম? পিতামহী বা মাতামহীর মধ্যে কেহ যদি অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে এন যাহারা ভারত ও পাকিস্তানের বাহিরে অন্য কোন দেশে বসবাস করিতে থাকে এ তাহারা যদি সংশ্লিষ্ট দেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিনিধির নিব নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে এবং ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিনিধি তাহাদিগা ভারতের নাগরিক বলিয়া তালিকাভুক্ত করেন তাহা হইলে এই সকল বিদো অবস্থানকারী ভারতীয়গণ নাগরিকত্ব অর্জ’ন করিতে পারিবে।
ভারতের ১৯৫৫ সালের নাগরিকতা আইন অনুসারে (১) জন্ম স (by birth), (২) রপ্তের সম্পর্কিত সূত্রে, (by descent), (৩) দেশীয়কর মাধ্যমে (by naturalisation), (৪) রেজিস্ট্রিকরণের মাধ্যমে (by registratio (৫) রাষ্ট্রভূস্তির (by incorporation of territory) মাধ্যমে নাগরিকত্ব অভ করা যায়।
নাগরিকত্ব বর্জনের কারণ
সব দেশে একই পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব বর্জিত হয় না। তবে সাধারণতঃ যে সকল কারণে এবং পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব বর্জিত হয় তা হল:
(১) কোন ব্যক্তি একই সময়ে দুইটি রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না। সে যদি অপর কোন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তবে তাকে স্বরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে।
(২) কোনো বিদেশীর সাথে বিবাহিত স্ত্রীলোকের স্বরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারিয়ে যায়।
(৩) অনেক সময় অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করলেও নাগরিকত্ব চলে যায়; যেমন, সৈন্যদল থেকে পালিয়ে গেলে, বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত উপাধি গ্রহণ করলে, স্বরাষ্ট্র থেকে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে নাগরিকত্ব লোপ পায়।
ভারতের নাগরিকত্ব বর্জন পদ্ধতি
(১) ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইনে বলা হয়েছে যে, কোন ভারতীয় নাগরিক যদি দেশীয়করণ, রেজিস্ট্রিকরণ বা অন্য কোন পদ্ধতিতে স্বেচ্ছায় অপর কোনও দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তবে তার ভারতের নাগরিকত্ব হারাবে। অবশ্য, ভারতের নাগরিক যদি কমনওয়েলথভুক্ত কোনও দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তবে সে ভারতের নাগরিকত্ব হারাবে না।
(২) আইনের ৮নং ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একই সময়ে ভারত ও অন্য আর কোন দেশের নাগরিক হয়, তবে সে ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিকত্ব বর্জন করতে হবে।
(৩) আইনের ১০ নং ধারা অনুসারে দেশীয়করণ ও রেজিস্ট্রিকরণ পদ্ধতিতে যারা ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেছে এবং সংবিধান চালু হবার ৫ বৎসর পূর্ব থেকে ভারতে বসবাস করছে এবং ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী ভারতের স্থায়ী বসবাসকারী হিসাবে নাগরিকত্ব অর্জন করেছে তাদের ক্ষেত্রে ভারত সরকার আদেশ প্রদান করে নাগরিকত্বের বিলোপ ঘটাতে পারেন।
(ক) যে সকল নাগরিক ভারতীয় সংবিধানের প্রতি অসন্তুষ্ট হবে এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের অভাব প্রদর্শন করবে বা যাদের আনুগত্যের অভাব অনুভূত হবে তাদের নাগরিকতার বিলুপ্তি ঘটানো যাবে।
(খ) যদি কোন বাক্তি অসদুপায়ে নাগরিকত্ব লাভ করে তাহলে তার নাগরিকত্বের অবসান ঘটানো যাবে।
(গ) দেশীয়করণ অথবা রেজিস্ট্রিকরণ পদ্ধতিতে যারা নাগরিকত্ব অর্জন করবে তারা যদি দুই বা ততোধিক বৎসরের জন্য কোন দেশে কারাভোগ করে তাহলে তাদের নাগরিকতার বিলুপ্তি ঘটানো যাবে।
(ঘ) যুদ্ধের সময় দেশের শত্রুপক্ষীয়দের সঙ্গে ব্যবসায় লিপ্ত হলে সংশ্লিষ্ট নাগরিকের নাগরিকত্ব লোপ পাবে।
(ঙ) ভারতের কোন নাগরিক যদি উপর্যুপরি ৭ বৎসর ভারতের বাইরে সাধারণভাবে বাস কবে অথচ সে ভারতের বাইরে কোন দেশের বিদ্যালয়ের ছাত্র নয় বা ভারতীয় বৈদেশিক প্রতিনিধিকে ভারতীয় নাগরিকতা রক্ষা করবার ইচ্ছা প্রতি বছর না জানায় বা ভারত যে সকল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য তার কোন একটিতে চাকুরী না করে তাহলে সরকার তার নাগরিকতার বিলুপ্তি ঘটাতে পারেন।
এছাড়া সৈন্যদল থেকে পালিয়ে গেছে এমন নাগরিকের নাগবিকত্ব বিলুপ্ত হতে পারে, আর কোন ভারতীয় নারী যদি কোন বিদেশীকে বিবাহ করে তাহলেও তার নাগরিকত্ব বিলুপ্ত হতে পারে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট মহিলা যদি নাগরিকত্ব রক্ষা করবার নিয়মাবলী মান্য করে চলে এবং ভারতের নাগরিকত্ব রক্ষা করতে ইচ্ছুক হয় তবে সে নাগরিকত্ব রক্ষা করতে পারবে।