আইনগত অধিকার রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত হয় এবং আইনগত অধিকার ভঙ্গের জন্য রাষ্ট্র অধিকারভঙ্গকারীকে দৈহিক শাস্তি দিতে পারে। আইনগত অধিকারকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—(ক) পৌর অধিকার বা ব্যক্তিগত অধিকার (civil or person rights), (খ) রাজনৈতিক অধিকার (political rights), (গ) সামাজিক অধিকার (Social rights) এবং (ঘ) অর্থনৈতিক অধিকার (economic rights)।
পৌর বা ব্যক্তিগত অধিকার (Civil or Personal Rights)
পৌর অধিকারের শুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। যে সমস্ত অধিকার আধুনিক রাষ্ট্রে সভ্য জীবনযাপনের জন্য নাগরিকের পক্ষে অপরিহার্য তাকেই পৌর অধিকার বলা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে নিম্নলিখিত পৌর অধিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাগরিকগণ ভোগ করে থাকে।
(১) জীবনের অধিকার (Right to life): সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পৌর অধিকার হল জীবনের অধিকার বা বেঁচে থাকার অধিকার। জীবনের অনিশ্চয়তা থাকলে অন্য সমস্ত অধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। জীবনের অধিকার নিশ্চিত করবার জন্যে রাষ্ট্রকে সুস্পষ্ট আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। খেয়ালখুশিমত কাউকেও হত্যা করবার সুযোগ বর্তমান সভ্য সমাজে স্বীকৃত হতে পারে না। জীবনের অধিকার বলতে আত্মরক্ষার অধিকারও বোঝায়। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে অন্যের ওপর বলপ্রয়োগও সমর্থন করা হয়। অধিকারের শুরুত্বের জন্যেই প্রতিটি জীবন মূল্যবান বলে স্বীকৃত এবং এই কারণেই কারও আত্মহত্যার বা নিজের জীবন নষ্ট করবার অধিকার আইনত স্বীকৃত হয় না।
(২) ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার (Right to personal liberty): কাম্য জীবনের জন্যই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রয়োজন। গতিবিধির স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের সুযোগ না থাকলে কাম্য জীবনযাপন সম্ভব হয় না। মানুষের স্বাধীন জীবনযাত্রার পথে অন্তরায় বলে বর্তমান সভ্য সমাজের দাসত্ব প্রথাকে কেউই সমর্থন করতে পারে না। ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশে গতিবিধির স্বাধীনতা ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ একান্তই অপরিহার্য। মানবাধিকারের সনদে কোন ব্যক্তির নির্বিচার আটকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে।
(৩) স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার (Freedom of opinion): স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ সভ্য সমাজজীবন যাপনের জন্য একান্তই অপরিহার্য। একে গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি বলে অভিহিত করা যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বাক্-স্বাধীনতা (freedom of speech) ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা (freedom of the press) বোঝায়। মানুষ আপন মনের চিন্তাভাবনাকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করবার সুযোগ লাভের মাধ্যমেই ব্যক্তিত্বের পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে এবং নাগরিকের যথার্থ দায়িত্ব পালন করতে পারে। স্বাধীন মত প্রকাশের অভাব গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করে। এই অধিকার নিরঙ্কুশ হতে পারে না। সম্মানহানিকর, অশ্লীলতাপূর্ণ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কিছু বলবার বা প্রকাশ করবার অবাধ অধিকার কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বীকৃত হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে অযৌক্তিক বা মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কোন অবস্থায় সমর্থন করা যায় না। নিয়ন্ত্রণ যুক্তিসঙ্গত কিনা তা বিচার করবার জন্য নিরপেক্ষ সংস্থার প্রয়োজন। অনেকের মতে, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুযাযন্ত্র বা সংবাদপত্রের ওপর বাক্তি-মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকায় মত প্রকাশের অধিকার স্বীকার করলেই হবে না, বাস্তবে তা কার্যকর করবার সক্রিয় ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন।
(৪) পরিবার গঠনের অধিকার (Right to family): মানব সমাজের বিবর্তন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পরিবার গঠনের অধিকার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের এবং রাষ্ট্রের বির্তনের বিভিন্ন যুগে সামাজিক সংস্থা হিসাবে পরিবার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করছে। গ্রীক মনীষী অ্যারিস্টটল পারিবারিক জীবনকে সমাজবন্ধনের মূল ভিত্তি বলে স্বীকার করেছেন। পারিবারিক জীবনের শঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা বৃহত্তর সমাজজীবনে নাগরিক দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। এই অধিকারের তাৎপর্য হল এই যে, পারিবারিক জীবনযাপনে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সন্তান প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের নিরাপত্তা স্বীকার করতে হবে। পরিবারকে অস্বীকার করে বর্তমান সমাজজীবন কল্পনা করা যায় না।
(৫) সম্পত্তির অধিকার (Right to property): সম্পত্তির অধিকার বলতে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি অর্জন, ভোগ দখল ও দান-বিক্রয়ের অধিকার বোঝায়। সমাজব্যবস্থার সুদুর অতীত অধ্যায় থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভোগ-দখল ও অধিকারের ধারণা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। সম্পত্তির অধিকারের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বর্তমানে তীব্র মতভেদ রয়েছে। বর্তমানে অনেকে সম্পত্তির অধিকার পবিত্র বা মৌলিক বলে স্বীকার করতে চান না। অনিয়ন্ত্রিত অধিকারও কেউ মেনে নিতে পারেন না। সমাজতন্ত্রের সমর্থকগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সম্পূর্ণ বিলোপ করতে চান। এ অধিকার ধনবৈষম্যমূলক সমাজেরই ফল এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্বই সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণী বিভেদের ও শোষণের মূল কারণ, তাদের দৃষ্টিতে সম্পত্তির অধিকার বিলোপ না করলে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে না অপরদিকে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থকগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের সহায়ক বলে মনে করেন। অবশ্য বর্তমানে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও সামগ্রিক জনকল্যাণের স্বার্থে সম্পত্তির অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করবার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
(৬) চুক্তির অধিকার (Right to contract): সভ্য সমাজজীবন যাপনের জন্য এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণ উপলব্ধির কারণে চুক্তির অধিকার বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে স্বীকৃত হয়েছে। ন্যায়সঙ্গতভাবে একে অপরের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হয় যে, এই অধিকার সীমাহীন বা অবাধ নয়। সমাজকল্যাণের পরিপন্থী কোন চুক্তিসম্পাদনের অধিকার স্বীকার করা যায় না। বে-আইনী, দুর্নীতিমূলক বা রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কোন চুক্তি কোন রাষ্ট্রই সমর্থন করে না। সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও রাষ্ট্রের আদর্শের আপেক্ষিক হিসাবেই চুক্তির অধিকার স্বীকৃত হয়।
(৭) স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার (Right to freedom of religion): ধর্মীয় রাষ্ট্রের (theocratic state) যুগে ধর্মের নামে মানুষের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়। বর্তমানকালে ধর্মীয় রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিলোপ না ঘটলেও ধর্ম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপক পরিবর্তন বিভিন্ন রাষ্ট্রে লক্ষ্য করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই অধিকাংশ রাষ্ট্রে বর্তমানে স্বীকৃত। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস ও বিবেক অনুযায়ী ধর্মাচরণের স্বাধীন অধিকার স্বীকার করা ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার স্বাধীন অধিকার বলে প্রতি রাষ্ট্র স্বীকার করলেও এ অধিকারের অজুহাতে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করবার সুযোগ কোন রাষ্ট্র স্বীকার করতে পারে না।
(৮) সংঘ গঠনের অধিকার (Right to association): মানুষ শুধু রাষ্ট্রের নাগরিক নয়, পরিবারের সদস্যও নয়, বৃহত্তর সমাজের বিভিন্ন সংগঠনেরও সদস্য, সংঘবদ্ধতা মানুষের মূল প্রবৃত্তির অন্যতম। এককভাবে কোন মানুষই বর্তমান সমাজজীবনে আপন মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না।। সংঘবদ্ধতার তাগিদে কখন মানুষ খেলার দল গড়ে, সঙ্গীতের আসর বসায়, বুদ্ধিবৃত্তির তৃষ্ণা মেটাতে সাহিত্যসভা, বৈজ্ঞানিক অধিবেশন বসায়, আলোচনা ও বিতর্কের আসর পাতে, আত্মিক প্রয়োজনের প্রেরণায় ধর্মীয় সংগঠন গড়ে। মানুষের জীবনের বিচিত্র প্রেরণা ও বহুমুখী চাহিদা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গড়া সংঘের মধ্যে রূপায়িত হয়। সংঘবদ্ধভাবে মানুষ জীবন সংগ্রামে নিজের দাবি দাওয়া প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য সংঘ গঠনের অধিকার একান্তই অপরিহার্য। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এই অধিকার বর্তমানে স্বীকৃত। কিন্তু সংঘগুলির সার্বভৌম অবাধ অধিকার কোন রাষ্ট্রই স্বীকার করতে পারে না। সুতরাং এ অধিকারও নিয়ন্ত্রিত অধিকার মাত্র।
(৯) আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার (Right to equality before law): অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মবিকাশের সুযোগ-সুবিধা, সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হলে অধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হওয়াই কাম্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় আইনে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত না হলে অধিকারের তাৎপর্য হারিয়ে যায়, রাষ্ট্রের আইন সকলকেই সমান সুযোগ দেবে। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের অধিকার সার্থক হতে পারে না। ধনী-দরিদ্রের প্রতিযোগিতায় আইন পক্ষপাতমূলক হতে বাধ্য। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকারকে কার্যকর করতে হলে শ্রেণী-স্বার্থের সুযোগ বিলোপ করতে হবে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে।