জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এফ. এইচ. হার্টম্যান জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করতে চায় এমন বিভিন্ন ধরনের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। অন্যদিকে ফ্রাঙ্কেল মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি। আবার মরগেনথাউ এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে একটি বোঝাপড়া। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে জাতীয় স্বার্থকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে।
(১) মৌলিক বা মুখ্য স্বার্থ: একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেসব স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল সেইসবস্বার্থকেই মৌলিক বা মুখ্য জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এইসব স্বার্থরক্ষা করতে না পারলে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই এই ধরনের জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যে-কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করে না। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সীমানাগত, রাজনৈতিক ইত্যাদি স্বার্থ হল এই শ্রেণিভুক্ত।
(২) গৌণ স্বার্থ: গৌণ জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার সলো জড়িত না হলেও সেগুলি রক্ষা করাকে রাষ্ট্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। এই ধরনের জাতীয় স্বার্থপূরণে রাষ্ট্র আগ্রহী হলেও এগুলি সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র কখনই যুদ্ধে যেতে চায় না। গৌণ জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টান্ত হিসেবে কূটনৈতিক কর্মীদের কূটনৈতিক সুযোগসুবিধার নিশ্চিতকরণ, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেঙ্গ বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ের কথা বলা যায়।
(৩) স্থায়ী স্বার্থ: প্রতিটি রাষ্ট্রের এমন কিছু স্বার্থ থাকে যেগুলি অপরিবর্তনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি এবং যেগুলির পরিবর্তন হয়ে থাকে অত্যন্ত ধীর গতিতে। এই ধরনের স্বার্থকেই একটি রাষ্ট্রের স্থায়ী জাতীয় স্বার্থ হিসেবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যেমন, জাতীয় স্বার্থে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা।
(৪) পরিবর্তনীয় স্বার্থ: এই শ্রেণির জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুলি বিশেষ একটা পরিস্থিতিতে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় কল্যাণের পক্ষে বিশেষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সলো সঙ্গে এই ধরনের স্বার্থেরও পরিবর্তন ঘটে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ, বিদেশনীতি নির্ধারকদের ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির দ্বারা এই ধরনের স্বার্থ নির্ধারিত হয়ে থাকে।
(৫) সাধারণ স্বার্থ: সাধারণ জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি রাষ্ট্রের সেইসব স্বার্থকে বোঝায় যেগুলির অগ্রাধিকার রাষ্ট্র তার গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করে। ইতিবাচক শর্তযুক্ত এই ধরনের জাতীয় স্বার্থ বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযুক্ত হতে পারে। যেমন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বার্থ সমানভাবে যুক্ত থাকে।
(৬) সুনির্দিষ্ট স্বার্থ: স্থান ও সময়ের মানদণ্ডে সাধারণ জাতীয় স্বার্থের যুক্তিসংগত সম্প্রসারণে নির্ধারিত স্বার্থসমূহকেই সুনির্দিষ্ট জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিকাশশীল দেশগুলির সাধারণ স্বার্থরক্ষীর নির্দিষ্ট কোনো প্রচেষ্টাকে এই শ্রেণিভুক্ত বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা যায়