আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ মূলক দৃষ্টিভঙ্গী; মার্কসবাদ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সমগ্র সমাজ জীবনের আলোচনা বা বিশ্ববীক্ষণ। কিন্তু আচরণবাদী এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলি হল—
(১) আচরণবাদ সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ স্বীকার করে এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ঘটনার বিচার করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সমাজের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র সমাজের প্রকৃতি বিচার করে না। মার্কসবাদ সমগ্র সমাজজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা ওপরি-কাঠামো বা রাজনৈতিক আইনগত বিষয়ে আলোচনা করে।
(২) আচরণবাদ রাজনৈতিক দল, উপদল, জনমত, ভোটদাতার আচরণ প্রভৃতি রাজনৈতিক ব্যবহার, উপকরণের ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সরকার, আদালত, প্রশাসন, আইনসভা প্রভৃতিকে কোন গুরুত্ব দেওয়া যায় না। মার্কসবাদীরা রাজনীতিকে সমাজের উপরি-কাঠামোর (Super Structure) এমন একটি অঙ্গ বলে মনে করেন যা রাষ্ট্র, তার বিভিন্ন সংগঠন, তার কার্যপ্রণালীর সঙ্গে জড়িত। সুতরাং একজন মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, জনমত, রাজনৈতিক দল, বিপ্লব, হিংসা সব কিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অঙ্গ বলেই মনে করেন।
(৩) আচরণবাদ সমাজের মধ্যস্থিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার-আচরণ পর্যালোচনার মধ্যে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার-আচরণ বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে মানব সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য কোন সত্য উদ্ঘাটন করা যায় কি না এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। মানব সমাজ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যোগফল মাত্র নয়। কিন্তু মার্কসবাদ এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা পার হয়ে সমগ্র সমাজ জীবনকে নিয়ে আলোচনা করে। সামাজিক অগ্রগতির বিষয়গত ও বস্তুগত উপাদানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ওপর মার্কসবাদ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।
(৪) আচরণবাদী তত্ত্বে ধারণার (Concept) ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তারা রাজনীতি পর্যালোচনার সময় ইতিহাসের প্রভাব বা গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। কিন্তু মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ইতিহাসের কষ্টিপাথরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী। তারা এই অভিমত পোষণ করেন যে, মানুষ ইতিহাসের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কতকগুলি স্বাভাবিক নিয়মের দ্বারা সমাজবিকাশের ইতিহাস রচিত ও পরিচালিত হয়।
(৫) আচরণবাদ মূল্য-নিরপেক্ষ (value-free)। আচরণবাদ সংখ্যাতত্ত্ব ও অভিজ্ঞতাবাদী অন্যান্য কলাকৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এটি অন্ধভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে প্রয়োগ করতে চায়। মানব সমাজকে একটি কৃত্রিম গবেষণাগার হিসাবে গণ্য করা হয়। মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ঘটনার বিশ্লেষণ অসম্ভব। তাই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী মানবতাবিরোধী। মার্কসবাদ সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। মার্কসবাদ সমাজ বিপ্লবের বিজ্ঞান। মার্কসবাদ, সামাজিক বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, শোষণ থেকে মানুষের মুক্তির পথ নির্দেশ করে। তাই মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মূল লক্ষ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণে সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে।
(৬) রক্ষণশীলতার পৃষ্ঠপোষকতা আচরণবাদের একটি বড় ত্রুটি। এই মতবাদ সমাজের গুণগত বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে। আচরণবাদ কেবল স্থিতাবস্থা সংরক্ষণে অধিক আগ্রহী। তাই একে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার তত্ত্ব (Status quo) বললে অত্যুক্তি হয় না। আচরণবাদ সমাজ পরিবর্তনের কারণ বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করে না। আচরণবাদীরা মার্কিন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কাম্য মনে করে আলোচনার সূত্রপাত করেন। কিন্তু মার্কসবাদ সমাজ বিপ্লবের বিজ্ঞান। বিপ্লবের মাধ্যমে প্রচলিত বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন মার্কসবাদের লক্ষ্য। তাই মার্কসবাদ প্রগতিশীল মতবাদ। সমাজের সকল সমস্যা, শোষণ বঞ্চনার ও দ্বন্দ্বের মূলে যে অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করে। সেই সত্যকে তুলে ধরাই মার্কসবাদের কাছে সর্বাপেক্ষা শুরুত্বপূর্ণ। আচরণবাদ এই সত্যটিকে অস্বীকার করে।
সুতরাং আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে মূলগত পার্থক্য রয়েছে।