১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এবং ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব, উভয় বিপ্লবের ওপরেই ফরাসি বিপ্লবের মূল প্রভাব দেখা যায়। জুলাই বিপ্লবের ক্ষেত্রে উদারনৈতিক ভাবধারা প্রবলতা পায়। ফরাসি বিপ্লবের গোড়ার দিকে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে যেমন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথা ভাবা হয়; সেরূপ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথাই ভাবা হয়। লুই ফিলিপ নিয়মতান্ত্রিক রাজা হিসেবে শপথ নেন। ফ্রান্সের বাইরে হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, সুইডেনেও নিয়মতান্ত্রিক আদর্শ প্রাধান্য পায়। জুলাই বিপ্লবে প্রজাতন্ত্র বা গণভোটের দাবি সফল হয়নি। জুলাই বিপ্লব ছিল মোটামুটিভাবে উদারনৈতিক রক্ষণশীল বিপ্লব।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা ছিলেন দশম চার্লস। তিনি জুলাই অর্ডিন্যান্স জারি করে আইনসভা ভেঙে দেন, সংবাদপত্রের অধিকার হরণ করেন, বুর্জোয়া শ্রেণীর ভোটাধিকার কেড়ে নেন। এভাবে জুলাই অর্ডিন্যান্স দ্বারা দশম চার্লস পুরাতনতন্ত্র স্থাপনের উদ্যোগ নেন। জুলাই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে উদারপন্থী ও প্রজাতন্ত্রী দলগুলি সক্রিয় প্রতিবাদ জানায়। শেষ পর্যন্ত ৩০শে জুলাই দশম চার্লস তাঁর পৌত্র ডিউক অফ বোর্দোর অনুকূলে পদত্যাগ করেন। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বুরবোঁ বংশের পতন ঘটে।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা ছিলেন লুই ফিলিপ। তিনি পাতি বুর্জোয়া ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোটাধিকার সংকুচিত করেন। ফলে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবী প্রবল হয়ে ওঠে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের ময়দানে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবীতে কেন্দ্রীয় জমায়েত সভা নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিষেধের ফলে ক্ষিপ্ত জনতা প্রতিবাদ জানালে রক্ষীদল গুলি চালায় এবং কিছু লোক নিহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে প্যারিসের বাম উদারতন্ত্রী দল, প্রজাতন্ত্রী দল এবং সমাজতন্ত্রী দল বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে লুই ফিলিপ ২৪শে ফেব্রুয়ারি তাঁর পৌত্রের অনুকূলে পদত্যাগ করেন। জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল চরমপন্থী। কারণ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র ও গণভোট স্থাপিত হয়। ফ্রান্সের বাইরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী চরিত্র লক্ষণীয়। সুতরাং ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের জ্যাকোবিন পর্যায়ের অনেকটা মিল দেখা যায়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল নিঃসন্দেহে জুলাই বিপ্লবের তুলনায় চরমপন্থী।
শ্রেণীগত দিক থেকে বিচার করলে, জুলাই বিপ্লবকে ধনী বুর্জোয়াদের বিপ্লব বলা যায়। একমাত্র বেলজিয়াম ছিল ব্যতিক্রম। অপর দিকে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল পাতি বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবি ও সাধারণ লোকের বিপ্লব। এই বিপ্লবে এই সকল শ্রেণীই ছিল কর্ণধার। তাছাড়া ফ্রান্সে এই বিপ্লবের একটি সমাজতান্ত্রিক দিকও ছিল। ফরাসী শ্রমিক ও সমাজতন্ত্রবাদীরা ফ্রান্সে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। বেকারের কর্ম সংস্থানের জন্যে জাতীয় কর্মশালা স্থাপিত হয়।
ফলাফলের দিক থেকে জুলাই বিপ্লবের দ্বারা বেলজিয়ামের স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হয়। ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র ও গণভোট স্থাপিত হয়। জার্মানীর ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, প্রাশিয়া ও ইতালির পিডমন্টে নিয়মতান্ত্রিক শাসন স্থাপিত হয়। তবে শেষের বিপ্লবের ফলে ভিয়েনা চুক্তির প্রতিক্রিয়াশীল ভিত্তি ধ্বসে যায়। ঐতিহাসিক সি.ডি. হ্যাজেন ফ্রান্সে উভয় বিপ্লবের তুলনার পর বলেছেন যে, “ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল অসাধারণভাবে দ্রুতগতি সম্পন্ন, ভয়ঙ্করভাবে চরমপন্থী এবং সম্পূর্ণভাবে অপ্রত্যাশিত”।
বহু গবেষক হ্যাজেনের মতের সঙ্গে একমত হননি। কোব্বান বলেছেন ১৮৪৮-এ বিপ্লব না ঘটলে তা অন্য সময় নিশ্চয় ঘটত। হয়ত তার ফলাফল হত আলাদা। তবে বিপ্লব ঘটার মত পরিবেশ ১৮৩০-এর পর থেকে দানা বেঁধেছিল। পাতি বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রী ও শ্রমিকের সমর্থক প্রজাতন্ত্রীদের হতাশাবোধ ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে অনিবার্য করে। সুতরাং বিপ্লব অপ্রত্যাশিত ছিল না। এই বিপ্লব নিঃসন্দেহে জুলাই বিপ্লবের তুলনায় চরমপন্থী ছিল। তার কারণ ফ্রান্স শিল্প-বিপ্লবের পথে দ্রুত আগাচ্ছিল এবং লুই ফিলিপের শিক্ষানীতির ফলে ফ্রান্সে শিক্ষাবিস্তার হচ্ছিল। তাছাড়া মিশেল, থিয়ার্স প্রভৃতি ঐতিহাসিক মহান ফরাসী বিপ্লবের পুনর্মূল্যায়ণ করায় প্রজাতন্ত্রী আদর্শ প্রবল হয়।