ভারতের নির্বাচন যাতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় এবং নির্বাচন ব্যাপারে কোন দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্ব দেখা না দেয় তার জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ ধারা অনুসারে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পার্লামেন্ট ও রাজ্য আইনসভাগুলির সদস্য নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন তালিকা প্রণয়ন ও নির্বাচন পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের সকল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর নাস্ত হয়েছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের গঠন [Composition of Election Commission of India]
নির্বাচন কমিশন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে গঠিত হয়। অন্যান্য কমিশনারদের সংখ্যা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করেন। এদের নিয়োগ করবার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির। রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কয়েকজন আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করতে পারেন। নির্বাচন গুরুদায়িত্ব স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পালন করবার জন্য নির্বাচন কমিশনকে যথাসম্ভব শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে।
সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের যে পদ্ধতি শাসনতন্ত্রে নির্দিষ্ট আছে, মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে কেবলমাত্র সেই পদ্ধতির মাধ্যমে অপসারণ করা যায়। পার্লামেন্টের প্রতি কক্ষে দুর্নীতি বা অযোগ্যতার জন্যে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হলে ইনপীচমেন্ট পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে পদ থেকে অপসারণ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্য এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনারদের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সুপারিশ ব্যতীত পদচ্যুত করা যায় না।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি. এন. শেসনের (T. N. Seshan) কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সকল রাজনৈতিক দলের সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি বহু-সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করেছেন। কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব এম. এস. গিল (M. S. Gill) এবং আইন কমিশনের প্রাক্তন সচিব জি. ডি. জি. কৃষ্ণমূর্তিকে অন্য দুই সদস্য হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের কার্যাবলী [Functions of Election Commission of India]
ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দায়িত্ব বা কার্যাবলী হল—
- পার্লামেন্ট, রাজ্য আইনসভা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থার নির্বাচনের ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধন।
- সংবিধান ও আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, পার্লামেন্ট, রাজ্য আইনসভার নির্বাচন পরিচালনা ও তদারক করা।
- নির্বাচনের কর্মসূচী অর্থাৎ দিন স্থির, মনোনয়নপত্র পেশ, প্রত্যাহার ও মনোয়নপত্রের বৈধতার পরীক্ষা প্রভৃতির ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের।
- নির্বাচন পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের অনুরোধ করা।
- বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী প্রতীক বণ্টন করা।
- কারচুপি, দুর্নীতি বা নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোন কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত, বাতিল বা পুনর্নির্বাচনের আদেশ দিতে পারে।
- সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্যে রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যে নির্বাচনী আচরণ বিধি (Code of Conduct) তৈরী করতে পারে।
- নির্বাচন কমিশনের নিয়মবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করার জন্যে কমিশন পরিদর্শক (observer) নিয়োগ করে।
সমালোচনা [Criticism]
ভারতীয় সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত ব্যবস্থা একথা বলা যায় না।
- সংবিধানে নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা কার্যকাল প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। শাসকদল এক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
- মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের চাকরীর শর্তাদি রাষ্ট্রপতি ধার্য করেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। অনেকের মতে বহুক্ষেত্রে কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে।
- অবসর গ্রহণের পর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে অন্য পদে নিয়োগ করা যায়। সরকারী অনুগ্রহ লাভের এই সুযোগ কমিশনের নিরপেক্ষতার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
- নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোন কর্মচারী নেই। এ বিষয়ে কমিশনকে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রয়োজনের সময় কমিশনকে অসুবিধায় পড়তে হয়।
- নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, কিন্তু আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের। কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব নয়। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন ও পরিচালনার ব্যাপারে অঙ্গরাজ্যের কোন ভূমিকা নেই। এ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কমিশনের সুপারিশ ও পরামর্শ মানতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য নয়।
মূল্যায়ন [Evaluation]
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার মূল্যায়নে অধ্যাপক মাহেশ্বরী বলেছেন, কমিশন ভারতীয় গণতন্ত্রের ৪টি স্তম্ভ—সুপ্রীমকোর্ট, রাষ্ট্রকৃতাক, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দুর্বলতম স্তম্ভ। অবশ্য পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম।