রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবদের কার্যালয় হল রাজ্য সচিবালয়। রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবদের নিয়ে গঠিত একটি যৌথ প্রশাসনিক সংস্থা। রাজ্য সরকারের যাবতীয় প্রশাসনিক নীতি, কর্মসূচি, আদেশ ও নির্দেশ বাস্তবে রূপায়ণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে রাজ্য সচিবালয়। ড. মাহেশ্বরী তাঁর ‘Indian Administration’ শীর্ষক গ্রন্থে সচিবালয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, সচিবালয় বলতে প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রককে বোঝায় যার প্রশাসনিক প্রধান হলেন সচিবগণ এবং রাজনৈতিক প্রধান হলেন মন্ত্রীবৃন্দ (“The expression Secretariat is used to refer to the complex of departments whose heads, administratively are Secretaries and politically Ministers.”)।
রাজ্য সচিবালয়ের গঠন
রাজ্য সচিবালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে। প্রতিটি দপ্তরের প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এক একজন সচিব। অবশ্য অনেক সময় একাধিক দপ্তরের দায়িত্বও একজন সচিবের হাতে ন্যস্ত থাকে। রাজ্য সচিবালয়ে সচিব ছাড়াও উপসচিব, অধস্তন সচিব, সহকারী সচিবরা রয়েছেন। বৃহৎ দপ্তরগুলিতে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিবরা থাকেন।
রাজ্য সচিবালয়ের দপ্তরগুলির সংখ্যা সব রাজ্যে সমান নয়। তবে সাধারণত সব রাজ্যেই কমবেশি ৩০ থেকে ৪০টি দপ্তর রয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যে সচিবালয়ের যে দপ্তরগুলি রয়েছে সেগুলি হল স্বরাষ্ট্র, অর্থ, রাজস্ব, শিল্প, শিক্ষা, পূর্ত, পঞ্চায়েত, সেচ ও বিদ্যুৎ, শ্রম ও নিয়োগ, আবগরি ও কর প্রভৃতি।
সরকারের কার্যনির্বাহী প্রশাসনিক দপ্তরগুলি সংশ্লিষ্ট সচিবদের অধীনে কাজ করে। এই দপ্তরগুলির শীর্ষে থাকেন বিভাগীয় প্রধান। যেমন—শিক্ষা দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান হলেন শিক্ষা অধিকর্তা। তিনি শিক্ষা সচিবের অধীনে কাজ করেন।
রাজ্য সচিবালয়ের ক্ষমতা ও কার্যাবলী
রাজ্য বিশেষে রাজ্য সচিবালয়ের কাজ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তবে সাধারণ প্রশাসন, অর্থনীতি ও অন্যান্য পরিষেবা-সম্পর্কিত কার্যাবলী সব রাজ্য সচিবালয়কেই সম্পাদন করতে হয়। সুতরাং, সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে:
প্রশাসন-সম্পর্কিত কার্যাবলী
- রাজ্যের মন্ত্রীদের রাজ্য প্রশাসন-সম্পর্কিত নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণে এবং তা রূপায়ণে সাহায্য করা।
- কেন্দ্রীয় সরকার, অন্যান্য রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা।
- সরকারি কর্মসূচি রূপায়ণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা।
- রাজ্যের অধিকর্তার কার্যালয়সমূহ ও ক্ষেত্রসংগঠনগুলিকে সরকারি কর্মসূচি রূপায়ণে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও পরামর্শ দেওয়া।
- রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাবিত বিলসমূহের বা আইনের খসড়া প্রস্তুত করা।
- কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত সর্বভারতীয় সম্মেলনগুলিতে এবং রাজ্যস্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
- প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করা।
- রাজ্য প্রশাসনের সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে কাজ করা।
অর্থনৈতিক কার্যাবলী
- অর্থ দপ্তরের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকারের বাৎসরিক আয়-ব্যয় বা বাজেট রচনায় সাহায্য করা।
- সরকারি অনুদান সম্পর্কিত শর্ত স্থির করা।
- বাজেট অনুযায়ী ব্যয় হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা।
- সরকারি গাণিতিক কমিটি, আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি এবং রাজ্য আইনসভায় উত্থাপিত বিভিন্ন আর্থিক বিষয়-সংক্রান্ত প্রশ্নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উত্তর তৈরি করা।
- রাজ্যের আকস্মিক ব্যয় তহবিল এবং সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন করা ইত্যাদি।
নিয়োগ বা চাকরি-সংক্রান্ত কার্যাবলী
- রাজ্যের সরকারি অধিকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
- রাজ্য সরকারি কর্মীদের চাকরির নিয়মাবলি ও শর্তাদি অনুমোদন এবং সংশোধন করা।
- রাজ্য সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে নতুন পদ তৈরি, পুনর্নিয়োগ, অবসর, বিশেষ বেতন ও ভাতা, অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ করা।
উপসংহার
রাজ্য প্রশাসনে রাজ্য সচিবালয় একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে সচিবালয়ের ক্ষমতার সুদূরপ্রসারী ব্যাপ্তি ঘটেছে। সচিবনির্ভর রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বেড়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। তবুও সচিবালয়ের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। ড. মাহেশ্বরী এই কারণে সচিবালয়কে সরকারের স্নায়ুকেন্দ্র বলে অভিহিত করেছেন।
রাজ্য সচিবালয় সম্পর্কে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
1. সচিব কী কী দায়িত্ব পালন করেন?
সচিব হলেন মন্ত্রীর প্রধান পরামর্শদাতা। তিনি রাজনৈতিক প্রধান কর্তৃক গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পাদনের জন্য দায়বদ্ধ থাকেন এবং আইনসভার কমিটির কাছে তাঁর বিভাগকে উপস্থাপন করেন।
2. রাজ্য সচিবালয় কাদের নিয়ে গঠিত?
রাজ্য প্রশাসনের প্রকৃত শাসক হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে রাজ্যে একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকে। এই দপ্তরের যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম দপ্তরের প্রধান দুটি শাখার দ্বারা পরিচালিত হয় একটি সচিবালয় এবং অন্যটি নির্দেশালয়। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষে রাজ্য সচিবালয়ের অবস্থান। রাজ্যের প্রশাসনকে কতকগুলি দপ্তরে ভাগ করা হয়। ওইসব দপ্তরের সমন্বয়েই গঠিত হয় রাজ্য সচিবালয়। দপ্তরগুলির রাজনৈতিক প্রধান হলেন মন্ত্রীরা এবং প্রশাসনিক প্রধান হলেন সচিবরা। মন্ত্রীরা যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেগুলিকে কার্যকর করেন প্রতিটি দপ্তরের রাষ্ট্রকৃত্যকের আধিকারিকরা।
3. সচিবালয়ের শীর্ষে থাকেন (সচিব/ অধিকর্তা)।
সচিবালয়ের শীর্ষে থাকেন সচিব।
4. রাজ্য সচিবালয়ের শীর্ষে কে থাকেন?
রাজ্য সচিবালয়ের শীর্ষে থাকেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।