বৈদেশিক নীতির অন্যতম নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রকের গুরুত্ব অর্জন করলেও জাতীয় স্বার্থ (National Interest) বলতে ঠিক কী বোঝায় সে-বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেননি। কারও কারও অভিমত হল, জাতীয় স্বার্থের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট হওয়ার এর সর্বজনগ্রাহ্য কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।
গল সিবিউরি তিনটি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর মতে—
- জাতীয় স্বার্থ হল কিছু আদর্শস্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি।
- জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমষ্টি যা প্রতিটি জাতি ও তার নেতৃবৃন্দ নিরন্তর অনুসরণ করে।
- অনেক সময় জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে।
জর্জ কেন্নানের বক্তব্য অনুযায়ী, জাতীয় স্বার্থ নামে তাকেই অভিহিত করা হবে কোনো দেশের স্বার্থ সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে যা আমরা জানতে ও অনুধাবন করতে পারি। হার্টম্যান বলেছেন, জাতীয় স্বার্থ হল তা-ই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্যরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হয় তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। কতকগুলি আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্র চালিত হয়। হ্যানস জে. মরগেনথাউ রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর অভিমত হল জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তার সামর্থ্যের সলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মরগেনথাউ আরও মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা শুধু যে নিজের জাতির স্বার্থের ধারণা সম্পর্কে সচেতন করে তাই নয়, অন্য জাতির স্বার্থ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে।
জোসেফ ফ্রাঙ্কেলের বক্তব্য অনুযায়ী, সংক্ষেপে এবং স্পষ্ট করে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় তা বলাও সম্ভব নয়। তবে বিদেশনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি। জাতীয় স্বার্থ শুধু যে একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপরও তা নির্ভরশীল। ফ্রাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল বিদেশনীতির মুখ্য ধারণা (“National interest is the key concept in foreign policy”)। তিনি এই অভিমতও পোষণ করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা জাতীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
প্রকৃত অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি যেগুলি অর্জনের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। মানবসমাজে যেমন ব্যক্তিগত লাভক্ষতির ধারণার দ্বারা ব্যক্তির আচার-আচারণ মূলত নিয়ন্ত্রিত হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনি রাষ্ট্রও মূলত জাতীয় স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়। জাতীয় স্বার্থরক্ষা করাই হল প্রত্যেক দেশের বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য। জাতীয় স্বার্থের ধারণার মধ্যে রাষ্ট্রের নিজস্ব লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ নিহিত থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা নিয়ন্ত্রণকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জাতীয় স্বার্থের ধারণা।