রাষ্ট্রের সাংগঠনিক নিয়মাবলী, যা বর্তমানে সংবিধান বা শাসনতন্ত্র নামে অভহিত করা হয় তার নজীর বহু দেশের প্রাচীনকালের ইতিহাসে পাওয়া যায়। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ‘Politics’ গ্রন্থে অনেক সংবিধানের উল্লেখ আছে। তিনি প্রায় শতাধিক সংবিধানের আলোচনা করে একটি আদর্শ সংবিধান রচনা করবাব চেষ্টা করেছিলেন। মধ্যযুগে নগর ও কর্পোরেশনের অধিকার সমূহকে লিপিবদ্ধ করবার নীতি লক্ষ্য করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্টুয়ার্ট রাজাদের সাথে পার্লামেন্টের বিবাদের মধ্যেও সংবিধানের পরিস্ফুট হয়। আমেরিকার সনদ, সামাজিক চুক্তিবাদীদের ধারণা, ধারণা, আমেরিকা ও ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণাবলী প্রভৃতি থেকে সংবিধানের ধারণা পাওয়া যায়। ১৮০০-১৮৮০ সালের মধ্যে ইউরোপে প্রায় তিন শতাধিক সংবিধান সংবদ্ধ হতে দেখা যায়। জনগণের অধিকার স্বীকার করতে গিয়ে ইংল্যান্ডের সংবিধান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও রাশিয়ার সংবিধান পরিবর্তিত হয়েছে।
সংবিধানের সংজ্ঞা (Definition of Constitution)
প্রতিটি সংগঠন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কতকগুলি সাধারণ নিয়মকানুনের প্রয়োজন। নিয়মকানুন না থাকলে সংগঠনের উদ্দেশ্যসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় না। রাষ্ট্র হল মানুষের রাজনৈতিক সংগঠন। মানুষের রাজনৈতিক জীবনকে পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হল রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এই উদ্দেশ্যের সাফল্য নির্ভর করে কতকগুলি রাজনৈতিক নিয়মকানুন সৃষ্টি ও তাদের যথাযথ প্রয়োগের উপর। এইসব নিয়মকানুন না থাকলে রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে; দেশের শান্তি, সমাদ্ধি ও অগ্রগতি ব্যাহত বা বিনষ্ট হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় মৌলিক নিয়মকানুনসমূহের সমষ্টিকে সংবিধান বা শাসনতন্ত্র বলা হয়।
লুইয়ার বলেন, যে উদ্দেশ্য ও যে সমস্ত বিভাগ দ্বারা শাসন-ক্ষমতা পরিচালিত হয় তাদের নিয়ন্ত্রণ করবার নিয়মাবলীকে সংবিধান বলে।
অ্যারিস্টটল বলেন, সংবিধান হল রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্বের শৃঙ্খলাবদ্ধকরণ।
উলস (Woolsey)-এর মতে, সংবিধান হল সেই সব নীতির একত্রীকরণ যেগুলি অনুসারে সরকারের ক্ষমতা, জনসাধারণের অধিকার এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়ে থাকে।
লর্ড ব্রাইসের (Bryce) মতে, সংবিধান হল আইনকানুন ও রীতিনীতির সমষ্টি যা রাষ্ট্রের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-এর মতে, সংবিধান হল কতকগুলি লিখিত বা অলিখিত নিয়ম যার দ্বারা সরকার গঠিত হয়, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন হয় এবং সেই বিভাগের কার্যাবলী নির্দিষ্ট করা হয়।
ডঃ ফাইনারের (Dr. Finer) মতে, সংবিধান হল মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আন্তঃসম্পর্কিত আবদ্ধতা। তিনি সংবিধানকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা সম্পর্কের আত্মজীবনী বলে অভিহিত করেছেন।
লোয়েনস্টাইনের (Lowenstein) মতে, সংবিধান হল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রধান যন্ত্র মাত্র।
ডাইসির মতানুসারে, সংবিধান হইল এমন কতকগুলি নিয়মকানুন যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহারের এবং বণ্টনের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
মার্কসবাদীদের মতে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সংবিধান হল ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে সৃষ্ট কতকগুলি নিয়মকানুন। এই নিয়মকানুন রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের কার্যক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে এবং কিভাবে এইসব বিভাগ পরিচালিত হবে তার নির্দেশ দেয়।
উপরের পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞাগুলি থেকে সংবিধানের প্রকৃত স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। তা হলো—সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কতকগুলি মৌলিক নীতিকে সংবিধান বা শাসনতন্ত্র বলে।
আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যাপক ও সংকীর্ণ—এই দুই অর্থে সংবিধান কথাটির প্রয়োগ করে থাকে।
ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে, কোন দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী লিখিত ও অলিখিত সর্বপ্রকার নিয়মকানুনকে বোঝায়। লিখিত নিয়মকানুন বলতে আইন এবং অলিখিত নিয়মকানুন বলতে প্রথা, প্রচলিত রীতিনীতি, আচারব্যবহার প্রভৃতি বোঝায়। যদিও সংবিধান প্রথা, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার প্রভৃতি আইনের মত আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়, তথাপি প্রতিটি দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এগুলির ভূমিকা বা গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার বা উপেক্ষা করা যায় না।
সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান বলতে, সেই সব লিখিত মৌলিক আইনকানুন যেগুলির দ্বারা সরকারের গঠন, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সংগঠন, ক্ষমতা ও সম্পর্ক নির্ণয় এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
সংবিধানের উপাদান (Contents of the Constitution)
(১) সংবিধানের প্রথমে একটি প্রস্তাবনা (Preamble) থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রস্তাবনায় সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করবে। সংবিধানের যে সকল ধারা স্পষ্ট নয় সে সকল ধারার ব্যাখ্যা করার সময় মূল লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে করা হবে।
(২) সংবিধানকে বলা হয় ব্যক্তি স্বাধীনতার উৎস। তাই সমাজ জীবনে নাগরিকগণ অপর নাগরিকের ও সরকারের সম্পর্কে কতটা অধিকার ভোগ করবে সংবিধান তা স্থির করে পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নিয়ন্ত্রণ করবে। সংবিধান শুধু অধিকার নির্ধারণ করিবে না, নাগরিকের কর্তব্যও স্থির করবে।
(৩) সুষ্ঠু শাসনকার্যের জন্য শাসকগোষ্ঠীর নির্বাচন পদ্ধতি, শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা এবং সরকারের কোন কোন ক্ষমতা নেই তা শাসন ব্যবস্থায় স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে।
(৪) আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ—এই তিন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে লেখা থাকবে।
(৫) সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকবে, অন্যথায় শাসকগণ নাগরিকদের অধিকারকে তাদের প্রয়োজনমত অস্বীকার করতে পারে।
(৬) সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু মৌলিক আইন সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়। আইন অনুসারে পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠিত হয়। সরকারি হিসাব নিরীক্ষা, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়।
আদর্শ বা উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য (Features of a Good Constitution)
(১) আদর্শ সংবিধানকে সুস্পষ্ট হতে হবে। যাতে সংবিধান ব্যাখ্যাকালে কোন মতবিরোধ না ঘটে।
(২) উত্তম সংবিধান লিখিত হতে হবে। লিখিত সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি সম্বন্ধে কোন প্রকার দ্বিমতের অবকাশ থাকে না।
(৩) আদর্শ সংবিধানকে যেমন ব্যাপক (Comprehensive) হতে হবে হইবে আবার সংক্ষিপ্ত হতে হবে। হোয়ারে বলেন: উত্তম সংবিধানের একটি অপরিহার্য গুণ হল সংক্ষিপ্ততা।
(৪) আদর্শ সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত।
(৫) উত্তম সংবিধান অতিরিক্ত মাত্রায় সুপরিবর্তনীয় আবার অতিরিক্ত মাত্রায় দুষ্পরিবর্তনীয় হবে না। আদর্শ সংবিধান মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে।
সংবিধানের প্রকারভেদ বা শ্রেণীবিভাগ (Types of Constitution)
সাধারণতঃ সংবিধানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়; যথা—(1) লিখিত ও অলিখিত সংবিধান, (2) সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান।
(1) লিখিত ও অলিখিত সংবিধান (Written and Unwritten Constitution): যে-দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত মোলিক নীতিগুলির অধিকাংশ বা সবগুলি একটি বা কয়েকটি দলিলে লিপিবদ্ধ করা থাকে তাকে ‘লিখিত সংবিধান’ (Written Constitution) বলে। কোন একসময় সাংবিধানিক মৌলিক নীতিগুলিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য একটি সংবিধান পরিষদ বা কনভেনশন আহূত হয়। এই পরিষদ বা কনভেনশন সংবিধান প্রস্তুত করে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি ঘোষণা করে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি দেশের সংবিধান লিখিত সংবিধানের উদাহরণ।
অপরদিকে শাসন সংক্রান্ত মৌলিক নীতিগুলি যখন প্রথা, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, বিচালয়ের সিদ্ধান্ত প্রভূতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তখন তাকে ‘অলিখিত সংবিধান’ (Unwritten Constitution) বলে। এরূপ সংবিধান রাষ্ট্রের ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়। ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, ইজরাইল, সৌদি আরব, প্রভৃতি দেশের সংবিধান অলিখিত সংবিধানের উদাহরণ।
লিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য:
- লিখিত সংবিধানের বিষয়বস্তুগুলি লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ থাকবে;
- আইন প্রণেতারা কোনো এক সময়ে সাংবিধানিক আইন বলে ঘোষণা ও প্রণয়ন করবেন।
অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য:
- অলিখিত সংবিধানের বিষয়গুলি এমন হতে হবে যা লিখিত সংবিধানে স্থান পেতে পারত, কিন্তু পাইনি;
- অন্যান্য দেশের সংবিধানে বিষয়গুলি স্থান পেয়েছে তার নজির।
লর্ড ব্রাইস বলেন, লিখিত সংবিধান ব্যাখ্যা ও রীতিনীতির দ্বারা সম্প্রসারিত হয়ে থাকে, ফলে কিছুদিন পরে লিখিত নিয়মকানুন থেকে ইহার স্বরূপ পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যায় না।
(2) সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান (Flexible and Rigid Constitution): লর্ড ব্রাইস সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয়—এই দুভাগে বিভক্ত করেছেন। আইনসভা যখন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংবিধান সংশোধন করতে পারে, তখন তাকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলে।। সহজ ভাষায়, যে সংবিধানকে অতি সহজে পরিবর্তন করা যায়, তাকে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের ধারাগুলি পরিবর্তনের জন্য কোন ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অবলম্বন করার প্রয়োজন হয় না। গ্রেট ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ইজরাইল, প্রভৃতি দেশের সংবিধান সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের উদাহরণ।
অপরদিকে সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতি অনুসারে যে সংবিধানকে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় না, তাকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলা হয়। সহজ ভাষায়, যাকে সহজে পরিবর্তন করা যায় না, তাকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের যে-কোন অংশের পরিবর্তনের জন্য ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অনুসরণ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা জাপান, প্রভৃতি দেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের উদাহরণ।
লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য (Distinction between Written and Unwritten Constitutions)
(১) সংবিধান পরিবদ বা কনভেনশন কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত সংবিধান ঘোষিত হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধান প্রথা, আচারব্যবহার, রীতিনীতি, বিচারালয়ের রায় প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে।
(২) লিখিত সংবিধানে সাংবিধানিক আইন হল দেশের সর্বোচ্চ আইন। তাই সরকার-সৃষ্ট আইন যদি সংবিধান-বিরোধী হয় তবে তা বাতিল হয়ে যায়। তাছাড়া লিখিত সংবিধান পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হলে ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অনুসরণ করতে হয়; সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতি অনুসারে লিখিত সংবিধান সংশোধন করা যায় না। লিখিত সংবিধান চরিত্রগতভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। কিন্তু অলিখিত সংবিধানের বিধানগুলি সুপরিবর্তনীয় হওয়ার জন্য সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতি অনুসারে আইনসভা কর্তৃক সেগুলি অতি সহজেই সংশোধিত বা পরিবর্তিত হতে পারে। তাই মর্যাদা ও গুরুত্বের দিক থেকে বিচার করে অনেকে লিখিত সংবিধানকে অলিখিত সংবিধান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন।
(৩) লিখিত সংবিধান যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু সরকার সংবিধান অনুসারে কাজ করতে বাধ্য থাকে। খেয়ালখুশিমতো সরকারের পক্ষে কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে যেহেতু আইনসভা রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী সেহেতু সরকার যে-কোন সময় প্রণয়ন করতে পারে।
(৪) লিখিত সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলী নির্দিষ্ট করা থাকে। ফলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজ করতে পারে না। তাছাড়া সরকারের কোন বিভাগ যদি সংবিধান-বিরোধী কোন কাজ করে তবে সে বিষয়ে যে-কোন ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত উক্ত বিভাগের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করতে সমর্থ। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগের হাতে কোন ক্ষমতা অর্পণ করা হয় না। আইন বিভাগ যেসব আইন প্রণয়ন করে সেগুলিকে বাতিল করার কোন ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকে না।
লিখিত সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধা (Merits and Demerits of Written Constitution)
লিখিত সংবিধানের দোষগুণ বা সুবিধা ও অসুবিধা উভয় সমভাবে বিদ্যমান।
সুবিধা বা গুণ বা গুণাবলী—
(১) লিখিত সংবিধান সংবিধান পরিষদ বা অনুরূপ কোন বিশেষ সংস্থা কর্তৃক প্রবর্তিত হয়। অনেক আলাপ-আলোচনা, তর্ক বিতর্কের পর লিখিত সংবিধান ঘোষিত হয় বলে সংবিধানের বিধানগুলি সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও বোধগম্য হয়। ফলে সরকার জনসাধারণ উভয়েই নিজ নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত থাকেন।
(২) লিখিত সংবিধান অলিখিত সংবিধান অপেক্ষা অনেক বেশী স্থায়ী। নিজ খেয়াল-খুশীমতো কিংবা আবেগপ্রবণ জনগণের চাপে পড়েও সরকার সহজে সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। এই পরিবর্তনের জন্য ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অনুসরণের প্রয়োজন।
(৩) জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ লিখিত সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। যেহেতু লিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না সেহেতু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ইচ্ছা করলেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না বা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায় যে, গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখার জন্য লিখিত সংবিধানের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্য বহু পরিমাণে নির্ভর করে লিখিত সংবিধানের উপর। কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সংবিধান অনুসারে করা হয়। সংবিধান লিখিত অবস্থায় না থাকলে ক্ষমতার প্রশ্নে যে-কোন সময় কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের বিরোধ হতে পারে। তাছাড়া, কেন্দ্র খেয়ালখুশি মতো রাজ্যসরকারগুলির ক্ষমতা নিজ কুক্ষিগত করতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
অসুবিধা বা দোষ বা ত্রুটি—
(১) লিখিত সংবিধানের প্রধান ত্রুটি হল দুষ্পরিবর্তনীয়তা। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে সংবিধান পরিবর্তন করা সহজসাধ্য হয় না বলে অনেক সময় লিখিত সংবিধানের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন বা বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। ফলে সরকারের অস্তিত্ব বজায় রাখা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
(২) মৌলিক অধিকারসমূহ সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হলেই যে জনসাধারণ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে এমন কোন কথা নেই। শ্রেণী বৈষম্যমূলক সমাজে জনগণের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে কার্যতঃ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, জনগণের সদাজাগ্রত দৃষ্টি এবং আত্মসচেতন মনোভাবই স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষাকবচ। ইংল্যান্ডের সংবিধান অলিখিত বলে ইংরেজরা অন্য জাতি অপেক্ষা কম স্বাধীনতা ভোগ করে একথা কোনোভাবেই বলা যায় না।
অলিখিত সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধা (Merits and demerits of unwritten constitution)
অলিখিত সংবিধানের দোষগুণ বা সুবিধা ও অসুবিধা উভয় সমভাবে বিদ্যমান।
সুবিধা বা গুণ বা গুণাবলী—
(১) অলিখিত সংবিধানের সর্বাপেক্ষা বড় সুবিধা হল নমনীয়তা। পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য অলিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায়। ফলে ক্ষমতাসীন দল জনমতের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে অতি সহজেই সংবিধান পরিবর্তন করে সরকারের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়। গণবিক্ষোভ বা গণবিদ্রোহ প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
(২) অলিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হওয়ার জন্য দেশের আপৎকালীন অবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা সম্ভব হয়। ফলে অলিখিত সংবিধান একদিকে যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠে, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় প্রয়োজনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
অসুবিধা বা দোষ বা ত্রুটি—
(১) অলিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তনশীল বলে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোন সময় সংবিধান সংশোধন করতে পারে। আবার জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কিংবা তাদের ভাবাবেগ ও উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য অকারণে বার বার সংবিধান সংশোধিত হলে সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যগুলি অনেক সময় পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে কল্যাণকর না হয়ে সংবিধান অকল্যাণকর হয়ে পড়ে।
(২) অলিখিত সংবিধান অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, অলিখিত সংবিধান অস্পষ্ট হওয়ার জন্য জনগণ নিজেদের অধিকারের সীমারেখা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে অজ্ঞ থাকে। ফলে সরকার যথেচ্ছভাবে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেও জনগণ তার প্রতিবিধানের জন্য অগ্রসর হতে পারে না। জনগণের এই অজ্ঞতার সুযোগে ক্ষমতাসীন দল বা বিবোধী গোষ্ঠী প্রশাসনকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। অলিখিত সংবিধান গণতন্ত্র-বিরোধী বলে অনেকে মনে করেন।
(৩) যুদ্ধরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে অলিখিত সংবিধান বিশেষভাবে অকাম্য। কারণ কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত নীতিগুলি যদি সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে লিখিত না থাকে তাহলে যে-কোন সময় উভয় সরকারের মধ্যে বিরোধ হতে পারে। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসরকারগুলির ক্ষমতা ধীরে ধীরে নিজ কুক্ষিগত করে নিতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এক- কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার রূপান্তরিত হতে পারে।
(৪) অলিখিত সংবিধান শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য নিরূপণ করে না। এর ফলে বিচার বিভাগ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ বিচার বিচার বিভাগ তখন সংবিধান অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন না করে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা প্রভৃতি অনুসারে বিচারকার্য পরিচালনা করে।
মন্তব্য: লিখিত কিংবা অলিখিত কোন সংবিধানই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি সভ্য দেশে সংবিধানকে লিখিত অবস্থায় গ্রহণ করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বস্তুতঃ সংবিধান লিখিত ও সুষ্পষ্ট হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে লিখিত সংবিধানকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার মত ব্যবস্থা সব সংবিধানের মধ্যেই রাখা প্রয়োজন। অন্যথায় সংবিধান প্রাণহীন জড় পদার্থের পর্যায়েই থেকে যাবে।
সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য (Distinction between flexible and rigid constitutions)
(১) সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে আইনসভা সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। অন্যদিকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘বিশেষ পদ্ধতি’ অনুসরণ করতে হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, সুপরিবর্তনীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনই যথেষ্ট। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট অপেক্ষা অনেক বেশী ভোটের প্রয়োজন।
(২) সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোনরূপে পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়। তাছাড়া, এরূপে সংবিধানে সাধারণ আইন অপেক্ষা সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনেক বেশী।
(৩) সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের উৎস এক এবং অভিন্ন। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে সাংবিধানিক আইনের উৎস সাধারণ আইনের উৎসের মত নয়।
(৪) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানমাত্রই লিখিত হয়। কিন্তু সুপরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত ও অলিখিত দুইই হতে পারে।
(৫) সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে আইনসভাই সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী। কারণ উক্ত সংবিধানে আইনসভার কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন উচ্চতর আইন থাকে না। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে আইনসভাকে সংবিধানের নিয়ন্ত্রণাধীন থেকে আইন প্রণয়ন করতে হয়। এক্ষেত্রে সংবিধান হল সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী।
(৬) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবন্ধ করা থাকে বলে অনেকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে গণতান্ত্রিক সংবিধান বলে অভিহিত করেন। অপরপক্ষে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি লিখিত অবস্থায় না থাকার জন্য সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে অগণতান্ত্রিক সংবিধান বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
লাওয়েলের মতে, “সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য মাত্রাগত পার্থক্যমাত্র, মূলগত কোন পার্থক্য নেই।” এখানে উল্লেখ্য যে, কোন দেশের সংবিধান পরিবর্তন করা হবে কিনা তা সংশোধন পদ্ধতির উপর যতখানি নির্ভরশীল ততোধিক অনেক বেশি নির্ভর করে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। সংবিধান তাঁদের স্বার্থের অনুপন্থী হলে অতি বড় সুপরিবর্তনীয় সংবিধানেরও পরিবর্তন সাধন করা হয় না। আবার সংবিধান তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হলে অতি বড় দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানও বারংবার পরিবর্তিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের আইনগত বা সংবিধান পরিবর্তনের পথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে না।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধা (Merits and Demerits of Flexible Constitution)
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের দোষগুণ বা সুবিধা ও অসুবিধা উভয় সমভাবে বিদ্যমান।
সুবিধা বা গুণ বা গুণাবলী—
(১) দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে সহজে পরিবর্তন করা যায়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করাই হল সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
(২) জনগণের মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য যদি সংবিধান পরিবর্তন করা না হয়, তবে তাদের মনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ একদিন বিক্ষোভ এবং গণবিপ্লবের আকার ধারণ করতে পারে। এদিক থেকে বিচার করে সুপরিবর্তনীর সংবিধান বিক্ষোভ বা গণবিপ্লবের হাত থেকে সরকারকে রক্ষা করে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রভৃতি বজায় রাখতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।
অসুবিধা বা দোষ বা ত্রুটি—
(১) সহজে পরিবর্তনযোগ্য হওয়ার জন্য সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অস্থায়ী বলে বিবেচিত হয়। সুদক্ষ রাজনীতিবিদরা সংবিধানকে হাতের পুতুলের মত যথেচ্ছভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে সহজেই ব্যবহার করতে পারেন।
(২) জনগণ আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে অনেক সময় সংবিধান সংশোধন করার দাবি জানাতে পারে। যেহেতু সংবিধান সংশোধন করা সহজসাধ্য, সেহেতু কেবলমাত্র জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য শাসকগোষ্ঠী অনেক সময় সংবিধান সংশোধন করে অনেক মৌলিক নীতির পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
(৩) সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রয়োজনমত সংবিধান সংশোধন করে নাগরিকদের অধিকারগুলি খর্ব করতে পারে। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ যেমন বিনষ্ট হতে পারে, তেমনি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারও বিলুপ্ত হতে পারে। তাই সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে অনেকে অগণতান্ত্রিক সংবিধান বলে অভিহিত করেন।
দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধা (Merits and Demerits of Rigid Constitution)
দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের দোষগুণ বা সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই সমভাবে বিদ্যমান।
সুবিধা বা গুণাবলী বা গুণ—
(১) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সর্বাপেক্ষা প্রধান গুণ হল স্থায়িত্ব। সংবিধান রচিত হওয়ার পর তাকে সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। ফলে জনসাধারণের ভাবাবেগ বা উচ্ছ্বাস কিংবা ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায় না।
(২) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত হয় ফলে সাংবিধানিক নিয়মগুলি সুস্পস্ট ও সুনির্দিষ্ট হতে বাধ্য। তার ফলে শাসন পরিচালনার ভিত্তি অধিক পরিমাণে সুদৃঢ় হয়। এরূপ সংবিধান সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হওয়ার জন্য সরকার ও জনসাধারণ নিজ নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত পাকেন। ফলে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি খর্ব করা সহজসাধ্য হয় না। তাই অনেকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে গণতন্ত্রের উপযোগী সংবিধান বলে বর্ণনা করেন।
(৩) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয় এবং সাধারণ আইন অপেক্ষা সাংবিধানিক আইনকে অধিকতর মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সে কারণে জনসাধারণ দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন।
(৪) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে একান্তভাবেই প্রয়োজনীয়। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সংবিধানে লিখিত থাকে। সংবিধান দূষ্পরিবর্তনীয় হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছামত রাজ্যসরকারগুলির স্বাতন্ত্য ক্ষুন্ন করতে পারে না।
অসুবিধা বা দোষ বা ত্রুটি—
(১) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান পরিবর্তন করা সহজসাধ্য নয় বলে পরিবর্তিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে সক্ষম হয় না। ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ, বিক্ষোভ প্রভৃতি আন্দোলন বা বিদ্রোহের আকার নিতে পারে। অনেক সময় দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান জনকল্যাণকর সংস্কার সাধনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
(২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মত দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানসমূহ সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয় বলে এরূপ সংবিধান কার্যত বিচার বিভাগের হাতের ক্রীড়নক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সংবিধানকে যুগোপযোগী করার জন্য বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করে।
মন্তব্য: সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ্য করে অধ্যাপক ল্যাস্কি উভয় প্রকার সংবিধানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, কোন একটি দেশের সংবিধান যেমন ব্রিটেনের সংবিধানের ন্যায় অত্যধিক সুপরিবর্তনীয় হওয়া উচিত নয়, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মত অত্যধিক দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য আইনসভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি যথেষ্ট। সংবিধানের সংশোধনের সরলতা ও কঠিনতার উপরই নির্ভর করে সংবিধানের গুণাগুণ।