বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুইমাচা’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় ১৩৩১ বঙ্গাব্দে। গল্পটি সংকলিত হয়েছে ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১) গল্পগ্রন্থে। এ গল্পেও বিভূতিভূষণের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী প্রকৃতি ও মানুষের এক সরল সহজিয়া মূর্তিই প্রকাশিত। অন্নপূর্ণা ও সহায়হরির তিন কন্যা সন্তান ক্ষেন্তি, পুঁটি ও রাধী এই ৫টি চরিত্র গল্পজুড়ে রয়েছে।
পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু
সাংসারিক সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন নিম্নবিত্ত গৃহস্থ পল্লীবাসী সহায়হরি চাটুজ্যে তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণার কাছে একটা ঘটি বা বাটি চেয়ে তিরস্কৃত হলেন। তারক খুড়ো খেজুর গাছ কেটেছে বলে একটু রস সংগ্রহ করে আনার ইচ্ছা ছিল সহায়হরির। কিন্তু তাঁর বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তির পরিণত হয়ে ওঠার লক্ষণ সত্ত্বেও সহায়হরি বিবাহের উদ্যোগ গ্রহণ না করে মাছ ধরে আর রস খেয়ে নিশ্চিন্তে উদাসীনভাবে দিনযাপন করছেন বলে অন্নপূর্ণা শান্ত স্বরেই আক্রমণ করেছেন। বিশেষত গ্রামে গুজব উঠেছে এরপর সহায়হরিকে একঘরে করা হবে। সে ব্যাপারেও সহায়হরিকে সচেতন করলেন অন্নপূর্ণা।
এমন সময় চোদ্দ-পনেরো বছরের ক্ষেন্তি তার আরো দুই ছোটো বোনকে নিয়ে এক বোঝা পাকা হলুদ হয়ে যাওয়া পুঁইডাঁটা নিয়ে বাড়ি ঢুকল। ছোটো একটি বোনের হাতে পুঁই পাতায় জড়ানো কিছু কুচো চিংড়ি। বাড়িতে ঢুকেই ক্ষেন্তি বোনের হাত থেকে মাছটা নিয়ে উৎসাহভরে জানালো যে গয়া বুড়ির কাছ থেকে সে ধারে চিংড়িগুলি এনেছে পুঁইশাক দিয়ে খাবার জন্য।
অন্নপূর্ণা সমস্ত বিষয়টিতে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। প্রায় কাঠ হয়ে যাওয়া পুঁইডাঁটা কারা বাগান থেকে কেটে ফেলে দিতে চেয়েছিল, সেগুলিকে তুলে আনায় ক্রুদ্ধ অন্নপূর্ণা সেগুলি ফেলে দিতে আদেশ করলেন। ক্ষেন্তির লোভকেও তিরস্কার করলেন অন্নপূর্ণা। ছোটো মেয়ে রাধী মায়ের আদেশে সেই পুঁই-এর বোঝা টেনে খিড়কির পুকুরে ফেলে দিল। সহায়হরি কুণ্ঠিতভাবে মেয়ের পক্ষ অবলম্বন করেও অন্নপূর্ণার ক্রোধ নিবারণ করতে পারলেন না।
ক্ষেন্তি পুঁইশাক চচ্চড়ি খেতে বড়ো ভালোবাসে। তার দুচোখ জলে ভরে উঠল। কিন্তু অন্নপূর্ণার ক্ষোভ অন্য কারণে। যে মেয়ের বিবাহের বয়স হয়েছে, তার এই লোভ বা আগানে-বাগানে ঘুরে বেড়ানো ভালো নয়। ক্ষেন্তির এই স্বভাব তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। আবার মায়ের মন। বকাবকি করার পর, যে কটা পুঁইডাঁটা ফেলে দেবার পরও এদিক ওদিক ছিটিয়ে ছিল, তা তিনি যত্নে বেঁধে ক্ষেন্তির পাতে দেন। রসনাপ্রিয় ক্ষেন্তি অবাক হয়, তৃপ্তি সহকারে খায়।
কালীময় গ্রামের মাথা। তিনি ক্ষেন্তির পাত্র হিসাবে শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলেকে ঠিক করে দেন। আশীর্বাদও হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে বদনামের সংবাদ পেয়ে সহায়হরি তার সঙ্গে ক্ষেন্তির বিবাহ দেন নি। তাই কালীময় চন্ডীমণ্ডপে ডেকে সহায়হরিকে সমাজচ্যুতির ভয় দেখান।
কিন্তু সহায়হরি উদাসীন। দুদিন পরে অন্নপূর্ণা ঘাটে যেতেই ক্ষেন্তিকে সঙ্গে নিয়ে বরোজপোতার বন থেকে চুরি করে এক প্রকান্ড মেটে আলু শাবল দিয়ে-খুঁড়ে তুলে আনে। ঘটনাচক্রে এই চুরির বৃত্তান্ত অন্নপূর্ণার কাছে অবিদিত থাকে না। ফলে সহায়হরির মিথ্যাচার অন্নপূর্ণাকে ক্রুদ্ধ করে। বিশেষ করে বিবাহযোগ্যা মেয়েকে চুরির ব্যাপারে সঙ্গে নেওয়ায় অন্নপূর্ণা বেশি ক্ষুব্ধ হন।
ইতিমধ্যে ক্ষেন্তি ভাঙা পাঁচিলের ধারে খোলা জমিতে একটি পুঁইগাছের চারা লাগিয়ে সোৎসাহে মাকে দেখায়। জামা-কাপড়-শখ-শৌখিনতা ক্ষেন্তির কিছু নেই; কেবল তুচ্ছ কয়েকটি জিনিস তার রসনাকে লালায়িত করে।
পৌষ সংক্রান্তিতে চালগুঁড়া, ময়দা, নারকেল ও গুড় দিয়ে অন্নপূর্ণা পিঠে ভাজতে বসলেন। গরম গরম পিঠে ভেজে অন্নপূর্ণা তিন মেয়েকে খেতে দিলেন। ক্ষেন্তি পরমতৃপ্তিভরে খেল এবং বেশিই খেল।
বৈশাখ মাসে দূর আত্মীয়ের ঘটকালীতে ক্ষেন্তির বিবাহ হয়ে গেল। পাত্রের বয়স প্রায় চল্লিশ, শহরে বাড়ি, চুন-ইটের ব্যবসায় করে যথেষ্ট সঙ্গতিসম্পন্ন। অন্নপূর্ণা দুশ্চিন্তায় পড়লেন, তার এই অবুঝ লোভী মেয়েটিকে কি তারা বুঝবে? আষাঢ় মাসে তাকে আনতে যাবার জন্যে সহায়হরিকে অনুরোধ করেছিল ক্ষেন্তি। কিন্তু পণের আড়াইশো টাকা বাকি থাকায় তাকে ঘরে আনা যায়নি। ফাল্গুনে ক্ষেন্তির বসন্ত হয়। বাড়িতে খবর না দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টালায় সহায়হরির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি ক্ষেন্তিকে দিয়ে যায়। সেখানেই ক্ষেন্তি মারা যায়।
পরের পৌষ পার্বণে অন্নপূর্ণা পিঠে বানানোর উদ্যোগ করছেন। পুঁটি ও রাধী পূর্বের মতোই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। তাদের দিদি বড়ো ভালোবাসত খেতে। অন্নপূর্ণার চোখও ক্ষেস্তির স্মৃতিতে সজল হয়। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল ক্ষেন্তির লাগানো সেই পুইগাছটি মাচার ওপর নধর, সুপুষ্ট, জীবনলাবণ্যে ভরপুর হয়ে গেছে।