বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রধানতম লেখক। সরকারী চাকুরীসূত্রে বহরমপুরে বাসকালে (১৮৭০-১৮৭৪) ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও বঙ্গদর্শন পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন রামদাস সেন, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, চন্দ্রনাথ বসু, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুভব করেছিলেন যে, সাহিত্যস্রষ্টা ও সংগঠক এই দুই ভূমিকা একসঙ্গে পালন করতে হলে সাময়িকপত্র একমাত্র শক্তিশালী মাধ্যম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন—”আমাদের বিবেচনায় সভ্যতা-বৃদ্ধির এবং জ্ঞান বিস্তারের সাময়িক সাহিত্য একটি প্রধান উপায়।… সাময়িকপত্র যদি যথাবিধি সম্পাদিত হয়, তাহা হইলে সাময়িক পত্রের সাধারণ পাঠকের অন্য কোনো গ্রন্থ পড়িবার বিশেষ প্রয়োজন থাকে না। আর সাময়িক পত্রের সমকালিন লেখক ও ভাবুকদিগের মনে যে সকল নূতন তত্ত্ব আবির্ভূত হয়, তাহা সমাজে প্রচারিত করিবার সাময়িকপত্র সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।”
‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশকালে অনেকগুলি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হলেও সে সময় যথার্থ উন্নতমানের সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ কোনো সাময়িক পত্র ছিল না। ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং তার সম্পাদক ঈশ্বরগুপ্ত সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা ছিল ঠিকই, কিন্তু পাশ্চাত্য ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্যপাঠে উন্নত হৃদয় বঙ্কিমচন্দ্রের পরিণত ভাবনাকে ধারণ করার সাধ্য ‘সংবাদ প্রভাকরের ছিল না। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাও ছিল মূলত বেদান্ত প্রতিপাদিত ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের মুখপাত্র, বঙ্কিমচন্দ্রের মতবাদের সঙ্গে ‘তত্ত্ববোধিনী’র বিরোধের কথা সর্বজনবিদিত। তাই বঙ্গভাষার স্বার্থে বঙ্গসমাজের মঙ্গলকামনায় বিদ্যা, বিজ্ঞতা ও বহুদর্শিতা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কঠিন দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাই প্রথম সচেতনভাবে নীরস সংবাদ পরিবেশনের পরিবর্তে চিন্তা ও রসসমৃদ্ধ সাহিত্যপত্ররূপে পাঠকসম্মুখে নিজেকে উপস্থিত করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করলেন, তখন তিনি তিনখানি ইতিহাস-নির্ভর রোমান্স কাহিনীর লেখক। কিন্তু ‘বঙ্গদর্শনে’ তিনি সচেতনভাবে বাঙালী তথা বাংলার সামাজিক উন্নতি সাধনের ব্রতও গ্রহণ করেছিলেন। ‘বঙ্গদর্শনে’র পত্রসূচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন—”সমগ্র বাঙালীর উন্নতি না হইলে দেশের কোনো মঙ্গল নাই।” এজন্যই সংস্কৃত মধুর কাহিনীর অনুবাদ বা ‘গোলেবকাওলি’র মতো গালগল্পে বা ইতিহাসের রোমান্সলোকের গোলোকধাঁধার অস্পষ্টআলোকে বাঙালী পাঠককে অযথা বিভ্রান্ত করা আর সম্পাদক বঙ্কিমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাঠকের চেতনাকে ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আধুনিক ও উন্নত করার প্রয়োজনে বঙ্কিমচন্দ্র এবার আবির্ভূত হলেন সামাজিক উপন্যাস রচয়িতা হিসাবে। ‘বঙ্গদর্শনে’র প্রথম সংখ্যা থেকেই প্রকাশিত হতে লাগল ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস।
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’ উনিশ শতকের নব্যবাংলার শিক্ষিত শ্রেণীর তথা বুর্জোয়া সমাজের মানস-সংকটকে উন্মোচিত করে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সৃষ্টি করলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—”তখন বঙ্গদর্শনের ধূম লেগেছে। সূর্যমুখী আর কুন্দনন্দিনী আপন লোকের মতো আনাগোনা করছে ঘরে ঘরে।”
এরপর ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে শুরু করে বঙ্কিমের প্রায় সমস্ত উপন্যাস ও বড়গল্পই (শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ বাদে) ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
শুধুমাত্র আখ্যান জাতীয় উপন্যাসের মধ্য দিয়েই ‘বঙ্গদর্শন’ বঙ্গসাহিত্যে নতুন দিগন্তের সঞ্চার করেছিল তা নয়, বস্তুত ‘বঙ্গদর্শনে’র পৃষ্ঠাতেই বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক প্রবন্ধ সাহিত্যের সূচনা ঘটালেন। ‘বিবিধ প্রবন্ধে’র অধিকাংশ প্রবন্ধ থেকে শুরু করে ‘লোকরহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘মুচিরামগুড়ের জীবন চরিত’ ইত্যাদি রচনাগুলিও ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করেছিলেন মাত্র চার বছর, ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ পর্যন্ত। পরে সঞ্জীবচন্দ্র ও শ্রীশচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। পরে ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে।
১৯০১-এ বঙ্গদর্শনের নবপর্যায়ের সম্পাদনা করতে বসেই রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন বঙ্কিম তথা বঙ্গদর্শনযুগের তাৎপর্য। তাঁর বিচারে ধরা পড়েছিল—”বঙ্গদর্শনের পূববর্তী এবং তাহার পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে উচ্চনীচতা অপরিমিত।… বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য আকস্মিক সমুন্নতিলাভ করিয়াছে একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাপ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।” আর এই তাৎপর্যটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই নবপর্যায়ের পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয়েছিল নবযুগের বিষবৃক্ষের কাহিনী—’চোখের বালি।’
উপন্যাসের গঠনশিল্পে ও বিষয়ে, প্রবন্ধের মৌলিকতা ও বৈচিত্র্যে, সম্পাদনার পরিশ্রমসাধ্য নিষ্ঠায়, গ্রন্থসমালোচনার অভিনবত্বে বঙ্কিমচন্দ্র তথা বঙ্গদর্শন বাংলা সাহিত্যের যে নব সূর্যোদয় ঘটিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ বারংবার বিভিন্ন আলোচনায় করেছেন। ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শনের ভূমিকা ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে লিখেছেন—“একদিন—বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনে যেদিন অকস্মাৎ পূর্ব-পশ্চিমের মিলনযজ্ঞ আহ্বান করিলেন—সেইদিন হইতে বঙ্গসাহিত্যে অমরতার আহ্বান হইল, সেইদিন হইতে বঙ্গসাহিত্য মহাকালের অভিপ্রায়ে যোগদান করিয়া সার্থকতার পথে দাঁড়াইল।”