রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় ত্রয়ী-বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) আবির্ভাব বাংলা কথাসাহিত্য জগতে নতুন যুগের সম্ভাবনার সূচনা করেছিল, তাঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০; Bibhutibhushan Bandyopadhyay)। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিজীবনে প্রধানত শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মাঝে মাঝে তাঁকে কর্মান্তর গ্রহণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এইভাবেই তাঁকে গোরক্ষিণী সভার প্রচারক, গৃহশিক্ষক, প্রাইভেট সেক্রেটারী, নায়েব, তহশিলদার প্রভৃতি বিচিত্র কর্মজীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিল। তাঁর বিচিত্র জীবনচর্যা তাঁকে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা আহরণের সহায়ক করেছিল। কর্ম-উপলক্ষে প্রতিনিয়ত বাসস্থান পরিবর্তনের কারণে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বাংলার পল্লীজীবন ও নাগরিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তেমনি ভাগলপুর, ঘাটশিলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকালে পাহাড় ও অরণ্যের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘পথের পাঁচালী’ রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্য-সাধনার যাত্রা শুরু করেন। অবশ্য অনেক পূর্বেই ‘প্রবাসী’ (১৩২৮ বঙ্গাব্দ) সাময়িকপত্রে ‘উপেক্ষিতা’ নামক ছোটগল্পে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল। এরপরে তিনি যথাক্রমে যে উপন্যাসগুলি রচনা করেন সেগুলি হল — ‘অপরাজিত’ (১৯৩২), ‘চাঁদের পাহাড়’ (১৯৩৭), ‘আরণ্যক’ (১৯৩৮), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘দেবযান’ (১৯৪৪), ‘কেদার রাজা’ (১৯৪৫), ‘ইছামতি’ (১৯৫০), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৫৯) প্রভৃতি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে প্রথম হাত পাকিয়েছিলেন এবং নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে দক্ষতা অর্জন করেছেন। তিনি দুই শতাধিক ছোটগল্প রচনা করেন এবং উনিশটি গ্রন্থে সংকলিত হয়। তাঁর প্রধান গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে—’মেঘমল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরিফুল’ (১৯৩২), ‘যাত্রাবদল’ (১৯৩৪), ‘তালনবমী’ (১৯৪৪), ‘কুশলপাহাড়ী’ (১৯৫০) প্রভৃতি। এগুলি ছাড়াও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ (১৯৩৫), ‘কিন্নর দল’ (১৯৩৮), ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘মুখোশ ও মুখশ্রী’ (১৩৫৪), ‘অভিযাত্রিক’ (১৯৪০), ‘বিপিনের সংসার’ (১৯৪১), ‘তৃণাঙ্কুর’ (১৯৪৩), ‘ঊর্মিমুখর’ (১৯৪৪) প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত ছাড়া বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শিশু সাহিত্য, দিনলিপি প্রভৃতি রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমকালীন লেখকদের তুলনায় সাহিত্যজগতে ভিন্ন পথের পথিক ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলিতে সমাজ-বাস্তবতা বা জীবন-সমস্যা প্রখরভাবে ফুটে ওঠেনি; পক্ষান্তরে তিনি অনেকটা কবি-দার্শনিক-সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখতে চেষ্টা করেছেন। যে তিনটি প্রধান উপাদানকে অবলম্বন করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে আছে প্রকৃতি চেতনা, অধ্যাত্মচেতনা এবং বর্তমান বিশ্বচেতনার স্বরূপ-উপলব্ধি ও অতীতের স্মৃতিচারণ। এই ত্রয়ীর সংযোগে সৃষ্ট জীবন-দর্শনকেই তিনি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে ও ছোটগল্পে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘পথের পাঁচালী’ ও দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের মধ্যেই একদিকে যেমন ব্যক্তি বিভূতিভূষণের সন্ধান লাভ করা যায়, তেমনি পাওয়া যায় তাঁর মানস-জীবনের পরিচয়। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’র মধ্যে লেখক উপন্যাসের বাঁধা পথ অবলম্বন করেন নি, একটি বালক-চিত্ত কীভাবে রূপকথার রূপলোকে বিচরণ করতে করতে অগ্রসর হল, জীবনের নানা ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও তার সে রূপজগৎ হারিয়ে গেল না, তারপর পুত্রের মধ্যেও সেই জীবন-প্রতীতি বয়ে চলল—সেই কথাটাই বিভূতিভূষণ অসাধারণ শিল্পরূপের দ্বারা ফুটিয়ে তুলছেন।” সম্মিলিতরূপে ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ যে অপূর্ব জীবনবোধের সৃষ্টি করেছে, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এমন সমান্তরাল আর কোন সৃষ্টি নেই—এটি একক ও অতুলনীয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘আরণ্যক’। এটি এমন একটি উপন্যাস যেখানে প্রকৃতি স্বয়ং নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। অতএব বিষয়বস্তুর বিচারে এর স্বকীয়তা সন্দেহাতীত। “উপন্যাস মহাকালের মধ্য দিয়ে চলমান মানব সভ্যতা ও সমাজের নানা ভাঙাগড়া উত্থান-পতনের প্রতিচ্ছবি—যা প্রধানত চরিত্র-নির্ভর। সমসময় এবং বৃহত্তর দৃষ্টিতে সমগ্র পৃথিবী ও পারিপার্শ্বিক লেখকের কাছে কি রূপে ধরা দিয়েছিল, লেখক সেটিকেই একটি মূল কাহিনী ও কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। ‘আরণ্যকে’ ঠাসবুনন কাহিনী অনুপস্থিত; যে কাহিনী রয়েছে তাতেও সুসংবদ্ধ ধারাবাহিকতা ও ক্রমে গল্প জমে উঠে শ্বাসরোধী উৎকণ্ঠার পর্যায়ে নিয়ে যাবার দিকটিকে বিভূতিভূষণ প্রাধান্য দেননি। তাই এ উপন্যাস একান্তই লেখকের মনোজগতের ইতিহাস, ব্যক্তিগত দর্পণে প্রতিফলিত প্রিয়বস্তুর ছবি।” বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যে একক। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এমন সাযুজ্য আর কোথাও দেখা যায়নি। ‘আরণ্যকে’র বিষয়বস্তু, বর্ণনা-বৈশিষ্ট্য, ভাষা-বৈশিষ্ট্য এবং সর্বোপরি নীচু তলার মানুষদের জীবন—প্রত্যেকটি বিষয়ই সমানভাবে আকর্ষণীয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপর সকল উপন্যাসের মধ্যেও প্রকৃতি চেতনার সঙ্গে অধ্যাত্ম-চেতনার অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। তাঁর আধ্যাত্মিকতাবোধের চরম বিকাশ ঘটেছে ‘দেবযান’ উপন্যাসে। তাঁর শেষ জীবনের উপন্যাস ‘ইছামতি’—যার জন্য তিনি মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেছেন, সেই গ্রন্থেও প্রকৃতিপ্রীতি ও আধ্যাত্মিকতাবোধের উৎকৃষ্ট পরিচয় লাভ করা যায়।
ঔপন্যাসিক-রূপে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, তাঁর ছোটগল্পগুলিতেও তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকন্তু ছোটগল্পকার-রূপে তিনি মানবহৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে লোকায়ত জীবনের যে পরিচয় দিয়েছেন, উপন্যাসে সেই দিকটি কতকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। এখানে তিনি প্রকৃতিকে ছেড়ে অনেকটা মানুষের কাছাকাছি এসেছেন এবং সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের আটপৌরে ঘরোয়া জীবনের বাস্তব চিত্রও অনেকটা তুলে ধরতে পেরেছেন। এ বিষয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব বক্তব্যটি স্মরণীয়। তিনি বলেছেন: যে সব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথা বলতেই হবে, তাদের সে গোপন সুখদুঃখকে রূপ দিতে হবে। বস্তুতঃ ছোটগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অঙ্গীকারমতো সাধারণ মানুষের সুখদুঃখকে রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ থেকে আরম্ভ করে ‘পুঁইমাচা’, ‘সংসার’, ‘ডাকগাড়ি’, ‘বিপদ’ প্রভৃতি গল্পে বঞ্চিত নারীজীবনের সেই আলেখ্যই অঙ্কিত হয়েছে। জীবনে দুঃখই শুধু সত্য নয়, জীবনের আনন্দঘন দিকটিকেও তিনি উপেক্ষা করেননি বলেই প্রেমানুভূতির আনন্দময় রোম্যান্টিক চিত্রও তাঁর কোন কোন গল্পে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গক্রমে ‘সুলোচনার কাহিনী’, ‘বিড়ম্বনা’, ‘বোতাম’, ‘চিঠি’, ‘অসাধারণ’ প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা চলে। বিভূতিভূষণের অনেক গল্পে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে-এ জাতীয় অনেক গল্প কিশোরদের উপযোগী। ‘অভিশপ্ত’, ‘বউচণ্ডীর মাঠ’, ‘প্রত্নতত্ত্ব’, ‘খুঁটি দেবতা’ প্রভৃতি গল্পে অপার্থিব রসের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃতির শিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে প্রকৃতি একেবারে নির্বাসিত হতে পারে না, তারই সন্ধান পাওয়া যায় ‘নদীর ধারে বাড়ি’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘শাবলতলার মাঠ’, ‘কনে দেখা’ প্রভৃতি গল্পে। এ ছাড়াও তাঁর প্রায় দুশত গল্পে বিচিত্র বিষয় ও রসের পরিচয় পাওয়া যায়—যা সর্বতোভাবে উপভোগ্য।