অন্তর্মুখী ভাবপ্রেরণায় যে কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথ আপন অন্তরের মধ্যে প্রেম ও সৌন্দর্যের বিশ্বরচনার বেদনা বহন করে ফিরতেন—তিনি ‘অবোধবন্ধু’ নামক একটি স্বল্প-প্রচারিত পত্রিকায় গুরুপদে বরণের যোগ্য একজন কবির সন্ধান লাভ করলেন। সেই কবির নাম বিহারীলাল চক্রবর্তী (Biharilal Chakraborty)। হেমচন্দ-নবীনের তুলনায় তাঁর কবিখ্যাতি কিছুই ছিল না। নিতান্ত বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যেই তাঁর পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার যে বিশিষ্ট ঐশ্বর্য রবীন্দ্র প্রতিভার দানে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে তার পূর্বসূচনা একমাত্র বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বগামী কবিদের মধ্যে একমাত্র বিহারীলাল চক্রবর্তীকে অকুণ্ঠিত ভাষায় আপন ‘কবিগুরু’ বলে উল্লেখ করেছেন।
সমসাময়িক বাংলা কাব্যের পরিবেশে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনন্যতা নির্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিহারীলাল চক্রবর্তী তখনকার ইংরেজি ভাষায় নব্যশিক্ষিত কবিদের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না—তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন। তাঁহার সেই স্বগত উক্তিকে বিশ্বহিত দেশহিত অথবা সভামনোরঞ্জনের কোনো উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এইজন্য তাঁহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।” কবিব্যক্তির ব্যক্তিত্বের অন্তর্লোক, তার সৌন্দর্যচেতনা, নিজস্ব-কল্পনার জগৎ—একান্তভাবে লিরিক কবির কাব্য-বিষয়। বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যে ভাষা ও ছন্দ, ব্যাকরণ ও ছন্দশাস্ত্রের যান্ত্রিক নিয়ম অস্বীকার করে সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতি ব্যঞ্জনার শক্তি সমন্বিত হয়ে উঠেছে। মধুসূদনের পরে বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় ভাষা এবং ছন্দ প্রয়োগ-বিধির এক তাৎপর্যময় নব প্রবর্তনার সূচনা করেন।
সারদামঙ্গল: বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলির নাম ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০), ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ (১৮৬৮), ‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০), ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯) এবং ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯)। এই কাব্যগ্রন্থগুলিতে বাংলা রোমান্টিক গীতিকবিতার যথার্থ সূচনা হয়েছিল। তাঁর কবিতাগুলি বিশ্লেষণ করলে রচনাভঙ্গির একটি বিবর্তনধারা অনুভব করা যায়। প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থগুলিতে কবি অনেক পরিমাণে বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করেছেন। প্রকৃতির দৃশ্যপট বা নারী সৌন্দর্যের বর্ণনায় তিনি প্রত্যক্ষত বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর। জাগতিক অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় কবিমানসের ভাবতরঙ্গগুলি কীভাবে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তার পরিচয় আছে ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘নিসর্গসন্দর্শন’ বা ‘বন্ধুবিয়োগ কাব্যে’। বাস্তব জীবনের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিই এইসব কাব্যের উপকরণ।
সৌন্দর্য এবং প্রেম-প্রীতি বিহারীলালের কবি হৃদয়ের জাগরণ মন্ত্র। তাঁর সৌন্দর্য চেতনা ও প্রেমবোধ জাগরিত হয়ে উঠে, এক সুতীব্র উৎকণ্ঠায় জাগতিক বন্ধনগুলি ছিন্ন করে যেন কোন এক শুদ্ধতর, পূর্ণতর উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ হতে চায়। জগতের কোলাহল শ্রুতির অগোচর হয়ে আসে। সব বিচিত্রতা একটিমাত্র সুরের প্রবাহে মিশে যায়, কবি তখন বলেন—
“মন যেন মজিতেছে অমৃত সাগরে
দেহ যেন উড়িতেছে সমাবেগ ভরে।”
এই সুরলোক উত্তরণের আগ্রহ কবির পরিণত কাব্যগুলিতে ক্রমে অধিক পরিমাণে পরিস্ফুট হয়েছে, তাঁর এই কবিস্বভাবের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় সারদামঙ্গল কাব্যে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য ছিল ‘সারদামঙ্গল’। সারদামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে কবি লিখেছেন, “মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ, সরস্বতী বিরহ, যুগপৎ ত্রিবিধ বিরহে উন্মত্তবৎ হইয়া আমি সারদামঙ্গল সঙ্গীত রচনা করি।” সারদামঙ্গলে একটি অস্পষ্ট কাহিনীর রূপরেখা আছে, কিন্তু সেই কাহিনী বস্তুজগতের কোন ঘটনা অবলম্বনে গড়ে ওঠে নি। সারদামঙ্গলের জগৎ একান্তভাবে কবির অন্তর্গত কল্পনার জগৎ। কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে তিনি সারদার মূর্তি রচনা করেছেন। এই কাব্যলক্ষ্মীর রূপ কল্পনায় কবির সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে ‘বিরহিত মৈত্রী-প্রীতি’র করুণা মিশ্রিত হয়েছে। কবিহৃদয়ের সৌন্দর্যবোধ এবং প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার নির্যাসে সারদাদেবীর তনু রচিত। কাব্যের সূচনায় বাল্মীকির কবিত্বলাভের প্রসঙ্গ-অবলম্বনে করুণাময়ী সৌন্দর্যলক্ষ্মী সারদার আবির্ভাব বর্ণিত হয়েছে, তারপর এই সারদার সঙ্গে কবির বিচিত্র লীলার বিবরণ বিভিন্ন সর্গে বর্ণনা করেছেন, “কখনও অভিমান, কখনও বিরহ, কখনও আনন্দ, কখনও বেদনা, কখনও ভৎসনা, কখনও স্তব। দেবী কবির প্রণয়িনীরূপে উদিত হইয়া বিচিত্র সুখ ও দুঃখের শতধারা সঙ্গীত উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিতেছেন। কবি কখনও তাঁহাকে পাইতেছেন, কখনও তাঁহাকে হারাইতেছেন, কখনও বা তাঁহার সংহার মূর্তি দেখিতেছেন। কখনও বা তিনি অভিমানিনী, কখনও বিষাদিনী, কখনও আনন্দময়ী”— (রবীন্দ্রনাথ)। বিশ্বচরাচরের সঙ্গে মানব হৃদয়ের সম্পর্কের ফলে যে সব অনুভূতি উন্মীলিত হয়, কবি সারদাকে অবলম্বন করে এমন একটি জগৎ রচনা করেছেন যেখানে তাঁর সেইসব ব্যক্তিগত অনুভূতিপুঞ্জ শুদ্ধতরভাবে প্রকাশ করা যায়। কবির কল্পনার বিশ্ব এই কাব্যে যেভাবে প্রকাশ লাভ করেছে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন আর কারও কাব্যে অনুরূপ দৃষ্টান্ত পাই না। কবি-প্রেরণার এই ভঙ্গি বাংলা কাব্যে সম্পূর্ণ নতুন। বিহারীলালের কবিতার রূপ অপেক্ষা ভাবের প্রাধান্য। বিশ্ব সৌন্দর্য তাঁর কল্পনাদৃষ্টির সামনে কায়ার বন্ধনমুক্ত হয়েই দেখা যায়। সেই নিরবয়ব শুদ্ধ সৌন্দর্যের প্রকাশ সারদার। সারদার বন্দনায় কবি বলেন—
“কায়াহীন মহা ছায়া,
বিশ্ববিমোহিনী মায়া,
মেঘে শশী-ঢাকা রাকা রজনী-রূপিণী
অসীম কানন তল
ব্যেপে আছে অবিরল,
উপরে উজলে ভানু ভূতলে যামিনী।’
এ সৌন্দর্য বস্তুবিশ্বের সৌন্দর্য নয়। বস্তু থেকে তার কান্তিটুকু নিষ্কাশিত করে নিয়ে কবি তার তনু নির্মাণ করেছেন। কবি-প্রেরণাকে বাইরে থেকে ভিতরে ফিরিয়ে কবি ব্যক্তির অনুভবের জগৎটিকে একান্তভাবে কাম্য-বিষয় করে তুলে বিহারীলাল বাংলা কাব্যে গীতিকবিতার একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন। উত্তরকালে বাংলা কাব্য এই পথে সমৃদ্ধতর পরিণামে উপনীত হয়েছে।
বিহারীলালের অপর কাব্যগুলির মধ্যে ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যে কবি জড়প্রকৃতির মধ্যেও প্রাণস্পন্দন বইয়ে দিয়েছেন। এর আগে বাংলা কাব্যে প্রকৃতির সঙ্গে কখনও মানব-মনের এমন নিবিড় সম্পর্ক অনুভূত হয় নি। বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর বঙ্গসুন্দরী কাব্যগ্রন্থে বাংলার গৃহচারিণী নারীর জননী-জায়া-কন্যা-ভগিনীরূপের বিচিত্র রূপ অঙ্কন করেছেন। বাঙালীর এই ঘরোয়া মূর্তির সঙ্গে নারীর রোমান্টিক- আইডিয়্যাল অভূতপূর্ব সমন্বয়-সাধন বিহারীলালের এক অপূর্ব কৃতিত্ব। বিহারীলালের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘সাধের আসন’কে সারদামঙ্গলের পরিশিষ্টরূপে গ্রহণ করা হয়। ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বিনী দেবী তাঁর প্রিয় কবি বিহারীলালের জন্য উৎকৃষ্ট আসন তৈরী করে তাতে সারদামঙ্গল-কাব্যের নিম্নোক্ত স্তবকটি বুনে দেন—
“হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
ঢুলু ঢুলু দুনয়নে
বিভোর বিহ্বল মনে কাহারে ধেয়াও?”
ভক্ত পাঠিকার ইচ্ছাপূরণার্থে কবি বিহারীলাল পাঠিকার অকালমৃত্যু সত্ত্বেও তার পর ‘সাধের আসন’ কাব্য রচনা করে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। এতে কবি তাঁর বিশুদ্ধ রসোপলব্ধিতে কিছুটা বস্তুময় ও তত্ত্বরূপ দিতে চেষ্টা করেছেন।