বিজন ভট্টাচার্য (Bijon Bhattacharya) বাংলা নাট্যজগতে গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। বাংলা নাটক উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজের বহির্বর্তী বৃহত্তর জনজীবনকে প্রায় স্পর্শই করতে পারেনি, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) সর্বপ্রথম গণ-জীবনের সঙ্গে নাটককে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করে। এই বিচারে বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে বিজন ভট্টাচার্যের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানাতে হবে।
বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যকৃতির আলোচনা-প্রসঙ্গে ‘গণনাট্য আন্দোলন’ বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হলে, প্রগতিবাদী-বিশেষভাবে মার্কসবাদী লেখকগণ, তাঁকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীবদ্ধ হতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন সোভিয়েত রাশিয়া যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন মার্কসবাদী লেখকগণ ফ্যাসিস্ট বিরোধী ‘লেখক ও শিল্পীসংঘ’ গঠন করে জনযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। তাদেরই প্রবর্তনায় বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ (১৯৪৩) ও ‘জবানবন্দী’ (১৯৪৩) নাটিকা রচিত হয়। ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘই নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে জন-সংযোগ করবার উদ্দেশ্যে ‘গণনাট্য সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠিতভাবে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফরিদপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে জন্ম হলেও পিতার কর্মসূত্রে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছেন। অতঃপর পড়াশোনার জন্য ১৯৩০ সাল থেকে তিনি কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করেন। এখানে তিনি প্রথমে ছাত্র-রাজনীতি এবং পরে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিজনের প্রথম সাহিত্য রচনা প্রচেষ্টা শুরু হয় ছোটগল্প ‘জলসা’ (১৯৩৯-১৯৪৬) দিয়ে। তিনি আর কোন ছোটগল্প রচনা করেন নি বলেই মনে হয়। তবে তিনি তিনখানি উপন্যাস রচনা করেছিলেন— ‘জনপদ’ (১৯৪৫) ‘রাণী পালঙ্ক’ (১৯৫৯), ‘সোনালী মাছ’ (১৯৬০-৬২)। এ সব কথা-সাহিত্য রচনা-সত্ত্বেও বিজন ভট্টাচার্য প্রধানত নাট্যকার-রূপেই পরিচিত ছিলেন। কথাটা আর একটু স্পষ্টতর করে বলা যায়, নাট্যজগতের যাবতীয় দিকের সঙ্গেই তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চমানের অভিনেতা ছিলেন এবং তার সে কৃতিত্ব শুধু মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চলচ্চিত্র অভিনয়েও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিজন নাট্যশিক্ষক ছিলেন এবং একজন উত্তম সংগঠকও ছিলেন। মতভেদের দরুন তিনি গণনাট্য সংঘ ত্যাগ করে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি আবার ‘কবচ-কুণ্ডল’ নামক নাট্যদল স্থাপন করেন।
বিজন ভট্টাচার্য রচিত নাটকের সংখ্যা অন্তত ২৫-২৬টি। তার মধ্যে যেমন একাঙ্কিকা আছে, তেমনি রয়েছে পূর্ণাঙ্গ নাটক, আছে গীতিনাট্য এবং রূপক নাট্য। আবার এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ (‘মাস্টার মশাই’ ও ‘গুপ্তধন’) এবং একাঙ্ক নাটকের সম্প্রসারণে পূর্ণাঙ্গ নাটক (‘কলঙ্ক’ ও ‘দেবীগর্জন’)। বিজনের নাটক সম্বন্ধে আরও একটি উল্লেখযোগ্য জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, তাঁর রচিত সমস্ত নাটক কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি। কোন কোনটি শুধু সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায়ই আত্মগোপন করে আছে, আবার কোনটির ভাগ্যে তা-ও জোটেনি, সেগুলি শুধু মঞ্চেই অভিনীত হয়েছে। যাহোক, নিচে তাঁর রচিত নাটকগুলির নাম ও রচনাকাল উল্লেখ করা হল।
- ‘আগুন’ (একাঙ্ক, ১৯৪৩),
- ‘জবানবন্দী’ (একাঙ্ক, ১৯৪৩),
- ‘নবান্ন’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৪৪),
- ‘অবরোধ’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৪৬-৪৭),
- ‘জীয়ন কন্যা’ (গীতিনাট্য, ১৯৪৫-৪৭),
- ‘মরাচাঁদ’ (একাঙ্ক, ১৯৪৬-৪৮),
- ‘কলঙ্ক’ (একাঙ্ক, ১৯৫০-৫১),
- ‘জননেতা’ (একাঙ্ক, ১৯৫০),
- ‘জতুগৃহ’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৫১),
- ‘গোত্রান্তর’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৫৬-৫৭),
- ‘মরাচাঁদ’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬০),
- ‘ছায়াপথ’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬১),
- ‘মাস্টারমশাই’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬১),
- ‘দেবীগর্জন’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬৬-৬৯),
- ‘ধর্মগোলা’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬৭),
- ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬৬),
- ‘সাগ্নিক’ (একাঙ্ক, ১৯৬৮),
- ‘গর্ভবতী জননী’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৬৯-৭১),
- ‘স্বর্ণকুন্ত’ (রূপক নাট্য, ১৯৭০),
- ‘আজ বসন্ত’ (পূর্ণাঙ্গ,১৯৭০),
- ‘লাস ঘুইর্যা যাউক’ (একাঙ্ক, ১৯৭০),
- ‘সোনার বাঙলা’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৭১),
- ‘গুপ্তধন’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৭২),
- ‘চলো সাগরে’ (পূর্ণাঙ্গ, ১৯৭০-৭২),
- ‘চুল্লী’ (একাঙ্ক, ১৯৭২- ৭৪),
- ‘হাঁসখালির হাঁস’ (একাঙ্ক, ১৯৭৪-৭৭)।
বিজন ভট্টাচার্যের নাটক-রচনার পশ্চাতে কোন সাহিত্য-প্রেরণা সদাসক্রিয় ছিল, এমন নয়, স্পষ্টতঃই তিনি একটি বিশেষ ভাবাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যেই সমসাময়িক কালের কিছু সমস্যামূলক কাহিনী অবলম্বন করে নাটক রচনা তথা মঞ্চস্থ করে জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। এতকাল আমাদের নাটকে শিক্ষিত, ভদ্র, বিত্তবান সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার রূপায়ণ ঘটতো। দীর্ঘকাল পূর্বের দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ বা তৎ-জাতীয় কিছু নাটক ব্যতিক্রম-রূপে গণ্য হত। বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে এতকালের অবহেলিত সমাজের বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের জীবনের বিচিত্র সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে পাদপ্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন। এককথায় এতকালের অবহেলিত শোষিত সাধারণ মানবজীবন—শুধু যে তাদের সব বঞ্চনা ও শোষণ নিয়ে মঞ্চে হাজির হলো তা নয়, তাঁরা নতুন বারে বাঁচবার প্রেরণাও লাভ করলো। তাই নতুন সমাজব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে নাটকের রূপায়ণে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হলো।
বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, ‘দেবীগর্জন’ প্রভৃতি কোন কোন নাটক বিশেষ মঞ্চসাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও সাধারণভাবে বলা চলে যে, ‘আগুন’ বা ‘জবানবন্দী’ থেকে শুরু করে ‘হাঁসখালির হাঁস’ পর্যন্ত সব নাটকেই মূলত একই ভাবাদর্শ বিভিন্ন কুশীলবের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বত্রই তিনি গণচেতনা সঞ্চারে উদ্যোগী, সর্বত্রই তাঁর নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। ‘নবান্ন’ নাটকে তিনি মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের প্রেক্ষাপট ও চরিত্র আদল গ্রহণ করেছেন। পাত্র-পাত্রীরূপে ‘কলঙ্ক’ নাটকে নিয়েছেন বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল-জীবনের কাহিনী; আবার ‘গোত্রান্তর’ নাটকের চরিত্র হল পূর্ব বাঙলার ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা। ‘অবরোধ’ নাটকে পাওয়া যাচ্ছে শ্রমিকদের ওপর মালিকদের অত্যাচার-কাহিনী; আর ‘দেবীগর্জনে’ রয়েছে গ্রামীণ কৃষকের ওপর জোতদারের জবরদস্তি চালানোর ইতিহাস। সর্বত্রই একশ্রেণীর মানুষের পাশব প্রবৃত্তি কিভাবে স্বার্থসিদ্ধির প্রেরণায় অপরকে সর্বস্বান্ত করে পথের ভিখারিতে পরিণত করে, কঠোর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের একেবারেই সর্বহারায় পরিণত করে, সেই বঞ্চনার, অত্যাচারের ইতিহাস নাট্যকার সংবেদনশীল দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে নাট্যকার হতাশাবাদী নন, সর্বত্রই তিনি প্রতিবাদকে, প্রতিরোধকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছেন, যার ফলে গণচেতনায় উদ্বুদ্ধ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস যে জয়যুক্ত হবে, তেমন একটি আশার আলোর আভাস তার নাটকের মধ্যে পাওয়া যায়। যেমন ‘নবান্ন’ নাটকে তিনি কেবল অবক্ষয় এবং বিপর্যয়ের ছবিই আঁকেন নি, চতুর্থ অঙ্কের দুটি দৃশ্যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতীক-রূপে ‘নবান্ন উৎসব’ উপস্থাপিত করেছেন।
নবনাট্য আন্দোলনের নাটকগুলি নানারকম ভাবে পূর্ববর্তী ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে প্রতিটি নাটকের গঠন কৌশল, নির্মাণ-রীতি, চরিত্র-পরিকল্পনা প্রভৃতি দিক থেকে স্বতন্ত্র। শিল্প কৌশলের বিচারে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশেষ গুণ হয়তো পাওয়া যাবে না, কারণ সাময়িকতার প্রয়োজনে বিশেষ উদ্দেশ্য, বিশেষ ভাবাদর্শ-প্রচারের হাতিয়ার-রূপে এদের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলি সম্বন্ধে এই অভিমত সর্বদা প্রযোজ্য।