দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Debendranath Tagore; 1817-1905) ছিলেন প্রধানত সমাজ ও ধর্মক্ষেত্রের সংস্কারক। রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর যে ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বিকাশ ঘটেছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ধর্মীয় প্রেরণার ফসল। তবে বাস্তব জীবনের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল সুগভীর। তখনকার সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে তিনি ছিলেন খুবই সংযুক্ত। দেশের শিল্প, সংগীত, ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে তাঁর প্রযত্ন ও মনীষার যোগ ছিল। তিনি ছিলেন ‘সর্বতত্ত্বদীপিকাসভার’ সম্পাদক। এই সভার অনুষ্ঠানপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘গৌড়ীয় ভাষার উত্তমরূপে অর্চনার্থে এই সভা সংস্থাপিত’।
তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মূল ঋগ্বেদের অনুবাদ করতে শুরু করেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় ঋগ্বেদের সেই অনুবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ ‘ব্রাহ্মাধর্মগ্রন্থ’ রচনা করেন। ১৮৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দ দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মতত্ত্ববিদ্যা’ প্রকাশিত হয়। ‘ব্রাহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস’ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। এটি মোট দশটি বক্তৃতার সংকলন। এতে ধর্মতত্ত্ববিৎ (Theologian) দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় পাওয়া যায়। অতঃপর ১৮৬১ ও ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ যথাক্রমে পশ্চিম প্রদেশের দুর্ভিক্ষ উপশমের সাহায্য সংগ্রহার্থে ‘ব্রাহ্মসমাজের ব্যাখ্যান’ এবং ‘ব্রাহ্মসমাজের উপদেশ’ প্রকাশিত হয়।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান’, ‘ব্রাহ্মধর্মের বিবাহ প্রণালী’ ও ‘ব্রহ্মাসমাজের পঞ্চবিংশতি বৎসরের পরীক্ষা বৃত্তান্ত’। ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দে তাঁর ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ ‘পরলোক মুক্তি’ প্রকাশের পর তাঁর ‘আত্মজীবনী’ ছাপা হয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গ্রন্থস্বত্বধিকার দানপত্রে লেখেন — ‘১৮ বৎসর হইতে ৪১ বয়ঃক্রম পর্যন্ত আমার জীবন-কাহিনী ঊনচল্লিশ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত।’ ‘আত্মজীবনী’ প্রকৃতপক্ষে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা ও তত্ত্বজ্ঞান লাভের ব্যক্তিগত বিবরণী।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পত্রাবলী। তাঁর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে নানা পত্রে যোগাযোগ ঘটে, প্রিয়নাথ শাস্ত্রী কর্তৃক সেগুলি পত্রাবলীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘকাল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি যে যুগে বাংলা গদ্য রচনায় প্রথম মনোযোগী হন, তখনও অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা গদ্য লেখক হিসেবে পরিচিত হন নি। প্রৌঢ় বয়সে যখন তিনি ‘ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান’ লেখেন, তখন আমাদের গদ্যরচনার ধারায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিভা সমকালীন প্রবীণ ও নবীন গদ্য-রচয়িতাদের কাছে পথ-নির্দেশক রূপে উপস্থিত। যখন তিনি তাঁর ‘আত্মজীবনী’ এবং ‘জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিভা তখন ছিল সমুন্নত শিখরে এবং ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনার পথে রবীন্দ্রনাথও বাংলা গদ্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য তাঁর নিজের কালেই বিভিন্ন মনীষীর দ্বারা সমাদৃত হয়। রাজনারায়ণ বসু তাঁর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক ‘বক্তৃতা’ গ্রন্থে লেখেন — ‘তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ না করিলে এবং বহুল আয়াস ও পরিশ্রম স্বীকার পূর্বক প্রথম তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রস্তাবগুলি বিশেষরূপে সংশোধিত করিয়া না দিলে বাঙ্গলা ভাষার উন্নতির পত্তনভূমি সংস্থাপিত হইত না। বিদ্যাসাগর মহাশয় যেমন আপনার প্রণীত ‘বেতাল-পঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থদ্বারা বঙ্গভাষার বর্তমান উন্নতির সূত্রপাত করেন, দেবেন্দ্রবাবুও সেই একই সময়েই পত্রিকা প্রকাশ ও সংশোধন দ্বারা সেই উন্নতির প্রথম সূত্রপাত করেন।’
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যে জ্ঞানান্বেষণ ও জ্ঞানানুরাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অনন্যসাধারণ কল্পনাশক্তি, রসপ্রবণতা ও সৌন্দর্যবোধ। তাঁর অনেকগুলি গদ্য নিবন্ধে ঈশ্বর সম্বন্ধে তিনি স্বীয় উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রভৃতি ভাবনাতেও তাঁর গদ্য, তত্ত্বভাবে কণ্টকিত হয় নি। সেই তত্ত্বের সঙ্গে সরসতা বিদ্যমান।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বচ্ছলতার লক্ষণ সে যুগের পক্ষে প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে বিদ্যমান। বাক্য-বিন্যাসে ও শব্দ-নির্বাচনে তিনি ছিলেন সচেতন এবং ভাবের সঙ্গে বাক্যের সামঞ্জস্য বিধানে খুবই যত্নশীল লেখক। দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর পরিশিষ্টে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে কথার উল্লেখ করে লেখেন — “তাঁহার হস্ত দিয়ে যে সকল লেখা যাইত, বা তাঁহাকে যাহা কিছু শোনানো হইত, তাহা তিনি সংশোধনের দ্বারা নিখুত না করিয়া ছাড়িতেন না, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁহাতে এই গুণ ছিল।” ‘আত্মতত্ত্ববিদ্যা’ গ্রন্থেই দেবেন্দ্রনাথের গদ্যরচনার শক্তির লক্ষণীয় প্রতিশ্রুতি বিদ্যমান। যেমন, যে সকল বস্তুকে দেখা যায়, শুনা যায়, স্পর্শ করা যায়, সেই সকল বাহ্যবস্তু, আর যে দেখে, যে শুনে, যে স্পর্শ করে, যে আঘ্রাণ করে, যে আস্বাদন করে, কিন্তু যাহাকে দেখা যায় না, শুনা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, আঘ্রান করা যায় না, সেই আমি জীবাত্মা।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যের অন্যতম গুণ সুস্পষ্টতা। কাশ্মীর ভ্রমণের বক্তৃতা থেকেই এই লক্ষণের উদাহরণ — ‘নদী দিয়া যাইতে যাইতে একটি সরোবরে আসিয়া উপনীত হইলাম। সরোবরটি গোলাকৃতি। পার হইতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। জল নীলবর্ণ।’ তাঁর রচনার এই সারল্য, স্পষ্টতা, সত্যবোধ ইত্যাদি সরল বিশ্বাস থেকেই জাত। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন — ‘সকল কর্তব্যকর্মেই তাঁহার ঈশ্বরের সত্তা ও সান্নিধ্যজ্ঞানের সহিত করার রীতি ছিল।’ তাঁর গদ্যে এই উপলব্ধি সঞ্চারিত করেছে বিশেষ এক স্বাদ।’
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য সাধুরীতি ও বর্ণনা প্রবণতার সঙ্গে তাঁর অনুভূতি গুণও লক্ষণীয়। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ থেকেই বাংলা গদ্যে অনুভূতি-প্রধান বিষয় বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও চিত্রণের এই নির্ঝরধারা বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথের গদ্যেরও মূলে যে তাঁর পিতার গদ্যরীতির প্রেরণা ছিল, এ-অনুমান ভিত্তিহীন নয়। দেবেন্দ্রনাথের গদ্যে সর্বত্রই স্বচ্ছন্দ গতি লক্ষণীয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিন্তা সহজ সরলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কোথাও শব্দের বা বস্তুর দুরূহতা নেই।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গদ্যে বাক্যের অন্বয় স্বচ্ছ ও শোভন রেখে শান্ত আবেগের সঙ্গে যুক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছেন। হৃদয়ের সহজ সরল সৌন্দর্যের স্বাদ তাঁর গদ্যে বিশেষভাবে অনুভূত হয়। দেবেন্দ্রনাথের গদ্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তাঁর ‘আত্মজীবনী’। এই গ্রন্থে তাঁর ভাবুক ও সাধক চিত্তের যন্ত্রণা, সংশয়, দ্বন্দ্ব এবং আনন্দধ্বনি ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। আত্মজীবনীতে একদিকে থাকে বিষয় সম্পর্কে স্রষ্টার সচেতনতা, অপরদিকে বিষয়ের ঊর্ধ্বে রচয়িতার সংগোপন হৃদয়। দেবেন্দ্রনাথ যেমন আত্মজীবনীতে তাঁর নিজের কালের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিমনের অনুভূতিগুলিও ব্যক্ত করেছেন। এই অভিব্যক্তিতে ভক্ত প্রাণের সঙ্গে কবি প্রাণের সুন্দর সুসমন্বয় সাধিত হয়েছে। যেমন— ‘আমি দেখি যে, তখন সন্ধ্যা হইয়াছে, সূর্য্য অস্ত গিয়াছে; আমার তো আবার এতটা পথ ফিরিয়া যাইতে হইবে। আমি দ্রুতবেগে ফিরিলাম। রাত্রিও দ্রুতবেগে আসিয়া আমাকে ধরিল। গিরি বন কানন, সকলই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। সেই অন্ধকারের দীপ হইয়া অর্দ্ধচন্দ্র আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল, কোন দিকে কোন সাড়া শব্দ নাই, কেবল পায়ের শব্দ পথের শুষ্ক পত্রের উপরে খড় খড় করিতেছে।…. রোমাঞ্চিত শরীরে সেই বনের মধ্যে ঈশ্বরের চক্ষু দেখিলাম—আমার উপরে তাঁহার অনিমেষ দৃষ্টি রহিয়াছে।’
‘আত্মজীবনীর’ আর একটি অংশে ভাষা প্রায় কাব্যময়। ‘ফাল্গুন মাস চলিয়া গেল, চৈত্র মাস মধুমাসের সমাগমে বসন্তের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল, এবং অবসর পাইয়া দক্ষিণবায়ু আম্রমুকুলের গন্ধে সদ্য প্রস্ফুটিত লেবু ফুলের গন্ধ মিশ্রিত করিয়া কোমল সুগন্ধের হিল্লোল দিগ্বিদিক আমোদিত করিয়া তুলিল। ইহা সেই করুণাময়ের নিঃশ্বাস।’
একথা নিঃসন্দেহে সুপরিচিত যে দেবেন্দ্রনাথ সাহিত্যিক ছিলেন না, কিন্তু বুদ্ধিবিচার, কল্পনাশক্তি, গভীর ও সূক্ষ্ম উপলব্ধি সমন্বিত অভিব্যক্তি তাঁর গদ্যে নিত্য নিত্য বিরাজিত। এই গুণেই তিনি বাংলা গদ্যের ‘উন্নতির পত্তনভূমি সংস্থাপিত করে গেছেন। তাঁর গদ্যের আলোচনা প্রসঙ্গে ‘চারিত্র পূজা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি স্মরণীয়— (দেবেন্দ্রনাথ) ‘নূতন ইংরেজি শিক্ষার ঔদ্ধত্যের দিনে শিশু বঙ্গ ভাষাকে বহুযত্নে কৈশোরে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।’
১২৫০ সালে ভাদ্রমাসে (১৮৪৩ খ্রীঃ) অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়। তখন থেকে বাংলা গদ্যে সারল্য, দৃঢ়তা ও সংযম তিনগুণের সুস্পষ্ট অনুশীলনের লক্ষণ দেখা দেয়। অধ্যাপক সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রনাথ বাংলায় বুদ্ধিদীপ্ত গদ্যের পথ পরিষ্কার করিয়া দিলেন।’