আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে পরম্পরার দিক থেকে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Hemchandra Bandyopadhyay; ১৮৩৮-১৯০৩) স্থান মধুসূদন দত্তের ঠিক পরেই। নিজের কালে মধুসূদনের চেয়েও তিনি বেশী জনসমাদর লাভ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ২৫ বছরে কবি-হিসেবে তাঁর অপ্রতিহত প্রতিষ্ঠা ছিল। মধুসূদনের বৈপ্লবিক প্রতিভা বাংলা কাব্যের আবহমান ধারার আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিল। নব্যশিক্ষায় আধুনিক পাঠকসমাজ ইংরেজী কাব্যের রসবস্তুর সঙ্গে পরিচিত হবার ফলে মাতৃভাষায় সেই রসাস্বাদ প্রত্যাশা করতেন। নবযুগের এই রূপান্তরিত রুচির পক্ষে আকাঙ্ক্ষিত কাব্যকলা সৃষ্টির পথ মধুসূদন দত্ত প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মধুসূদন দত্ত যতটা উচ্চাঙ্গে বাংলা কাব্যের সুর বেঁধে দিলেন — তার সঙ্গে তাল রেখে চলবার মত কবি-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বে আর আবির্ভূত হয়নি।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন—মধুসূদন দত্তের কাব্যের নতুন বাণীমূর্তির সৃষ্টিকৌশল হয়তো বুঝতেন, কিন্তু তেমন বস্তু সৃষ্টি করার যোগ্য প্রতিভা তাঁদের ছিল না। ফলে মধুসূদন-প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হলেও তাঁদের রচনায় মধুসূদনের ধ্রুপদী সুর অনেক পরিমাণে তরলীকৃত হয়েছে। সাধারণ পাঠকের পক্ষে মধুসূদনের কাব্যকলা দুরূহ মনে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সব ভাব এবং ভাবনাই সুগমভাবে উপস্থাপিত করায় পাঠকসাধারণ তাঁকে প্রিয় কবিরূপে, নিজেদের রুচি-প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন প্রতিভারূপে সমাদর করেছে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসমাদর লাভের মূল রহস্য এটাই। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে কালক্রমে পাঠকদের রুচির এবং রসবোধের মান পরিবর্তিত হয়। যে কবি যুগে যুগে বিবর্তনশীল জনরুচির দ্বারা সমানভাবে গৃহীত হন তাঁকেই বলা যায় যুগোত্তীর্ণ প্রতিভা। মধুসূদনের কাব্যের বিপুল জনসমাদর ছিল না। পরিশীলিত রুচি-বিদগ্ধ সমাজেই তাঁর কাব্য সমাদৃত হয়েছে। এতকাল পরে আজও এইরূপ উচ্চকোটির রসিক সমাজে মধুসূদনের কাব্যের সমাদর অক্ষুণ্ণই আছে। কিন্তু আজ আর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠক নেই। যে জনসাধারণ আপনাদের রুচির পরিমাপের অনুসারী বলে তাঁর কাব্যের সমাদর করত তাদের বিদায় গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি-খ্যাতি ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়ে পর্যবসিত হয়েছে।
বৃত্রসংহার কাব্য: প্রকাশকাল অনুযায়ী হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলির নাম ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ (১৮৬১), ‘বীরবাহু কাব্য’ (১৮৬৪), ‘কবিতাবলী’ (১৮৭০), ‘বৃত্রসংহার’ (প্রথম খণ্ড ১৮৭৫, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৭৭), ‘দশমহাবিদ্যা’ (১৮৮২) এবং ‘চিত্তবিলাশ’ (১৮৯৮)। মেঘনাদবধ কাব্যে মহাকাব্য রচনার একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর কাব্যধারার একটি অংশ মহাকাব্য জাতীয় রচনা। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত মহাকাব্য “বৃত্রসংহার” কাব্যের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে এবং এই কাব্য তাঁর কবিখ্যাতির প্রধান কারণ। ‘বৃত্রসংহার’ ২৪টি সর্গে সম্পূর্ণ। বৃত্রাসুর কর্তৃক ইন্দ্রের স্বর্গরাজ্য অধিকারের পর থেকে দধীচির অস্থি দ্বারা নির্মিত বজ্রের আঘাতে বৃত্রের পতন পর্যন্ত কাহিনী হেমচন্দ্র এই কাব্যে বর্ণনা করেছেন। পৌরাণিক কাহিনী নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপনের যে দৃষ্টান্ত মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্যে স্থাপন করেছিলেন হেমচন্দ্রও সেই পদ্ধতির অনুবর্তন করেছেন। ফলে এই কাব্যেও রাবণের মতো দেবদ্রোহী বৃত্রই নায়ক। রুদ্রপীড় চরিত্র মধুসূদন সৃষ্ট ইন্দ্রজিতের আদর্শে গঠিত। মেঘনাদবধ কাব্যে যেমন সীতার অপমান রাবণের পতনের হেতু—এই কাব্যেও সেইরূপ বৃত্রাসুরের পতনের হেতু ইন্দ্র-পত্নী শচীর লাঞ্ছনা।
মেঘনাদবধের তুলনায় বৃত্রসংহার কাব্যের পটভূমি অনেক বিস্তৃত এবং এই কাহিনীতে যথার্থ মহাকাব্যিক আবহ অনেক পরিমাণে পরিস্ফুট হয়েছে সন্দেহ নেই। চরিত্রসৃষ্টিতেও হেমচন্দ্র দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। হেমচন্দ্রের কাব্যে কল্পলোকের শুদ্ধ সৌন্দর্যের পরিবর্তে মাটির পৃথিবীর দ্বন্দ্বময় জটিলতাই বেশী, তাতে “গার্হস্থ্য জীবনের রূপ, রস, সাধারণ দ্বন্দ্ব-জটিলতা ও বিষণ্ণ করুণ অনুভূতি” প্রাধান্য পাওয়ায় সাধারণ পাঠকের পক্ষে এই কাব্যের রস গ্রহণ সহজসাধ্য হয়েছিল। মাঝে মাঝে পাতালপুরে দেবতাদের মন্ত্রণা, বিশ্বকর্মার যন্ত্রশালার বর্ণনা, বৃত্রাসুরের অন্তিম সংগ্রামের বিবরণ প্রভৃতি অংশে হেমচন্দ্রের গভীর ভাব-কল্পনার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু মাত্রাজ্ঞানের অভাবের ফলে সমগ্র কাব্যে তথ্য এমন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে যে কাব্যরস নিবিড় হয়ে ওঠবার সুযোগ পায়নি। কাব্যে এক বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে বৃত্র ও ঐন্দ্রিলার দাম্পত্য সম্পর্ক ও তাদের ভোগবৃত্তি এবং আত্মাভিমানের স্থূলতা। বৃত্র চরিত্র পরিস্ফুট করা হয়েছে প্রধানতঃ গার্হস্থ্য জীবনের পটভূমিতে। ফলে মেঘনাদবধের তুলনায় এই কাব্যে জীবনের বাস্তব আবেগের স্বাদ অনেক বেশী পাওয়া যায়। বাস্তব জীবনের সঙ্গে নিকট সম্পর্কের জন্যেই সমসাময়িক পাঠকদের কাছে এই কাব্য নিজেদেরই জীবনের কাব্যরূপ মনে হয়েছিল। মধুসুদন মানবিক প্রবৃত্তির যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আদর্শায়িতভাবে কল্পনার ইন্দ্রজালে মণ্ডিত করেছিলেন হেমচন্দ্র তাকে বাস্তব জীবনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার স্তরে নামিয়ে এনেছেন। হেমচন্দ্রের কাব্য উপভোগের জন্য তাই উচ্চ কল্পনার প্রয়োজন হয় না। এ কাব্য সাধারণ মানুষেরও আয়ত্তগম্য। বৃত্রসংহারে কোথাও কোথাও বর্ণনাভঙ্গিতে হেমচন্দ্রের কবি প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন অসুরসভায় বৃত্রের আগমন বর্ণনা—
“ত্রিনেত্র, বিশাল বক্ষ অতি দীর্ঘকায়,
বিলম্বিত ভুজদ্বয়, দোদুল্য গ্রীবায়
পারিজাত পুষ্পহার বিচিত্র শোভায়।
নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস;
পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ—”
হেমচন্দ্রের রচনাবলীর মধ্যে আখ্যানধর্মী কাব্য হিসেবে ‘বৃত্রসংহার’ ভিন্ন ‘বীরবাহু’ কাব্যটিও উল্লেখযোগ্য। ‘বীরবাহু’ কাব্যের কাহিনী সম্পূর্ণ কবির কল্পনাপ্রসূত। কবির নিজের ভাষায়, “পুরাকালে হিন্দু কুলতিলক বীরবৃন্দ স্বদেশ রক্ষার্থ কিরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন কেবল তাহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ এই গল্পটি রচনা করা হইয়াছে।”
খণ্ড গীতি-কবিতা: খণ্ড গীতি-কবিতা রচনার ক্ষেত্রে হেমচন্দ্রের কৃতিত্ব কম নয়। প্রধানত দেশাত্ববোধই তাঁর গীতি-কাব্যের উপজীব্য বিষয় ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর সদ্যোজাগ্রত দেশাত্মবোধকে হেমচন্দ্র ভাষা দিয়েছিলেন তাঁর ‘ভারত-সঙ্গীত’ এবং অনুরূপ আরও বহু গীতি-কবিতায়। দেশের জনমনে জাতীয়তার ভাব জাগ্রত করে তোলবার দিক থেকে এই সব কবিতার প্রভাব নগণ্য নয়। হেমচন্দ্রের তিনখানি কবিতা সংকলন ‘কবিতাবলী’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) এবং ‘চিত্তবিকাশ’-এ গীতি-কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আখ্যান-আশ্রিত বৃহৎ কাব্যের চেয়ে খণ্ড কবিতাতে হেমচন্দ্রের দক্ষতা বেশী ছিল। বিশেষভাবে তাঁর ব্যঙ্গকবিতাসমূহের পরিহাস-রসিকতা আজও আকর্ষণীয় মনে হয়। লংফেলো, শেলী, কীট্ট্স, পোপ, ড্রাইডেন প্রভৃতি বিদেশীয় কবিদের অনেক কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। বিদেশীয় কাব্যকলার সঙ্গে বাঙালী পাঠকদের পরিচয় সাধনের এই শ্রমসাধ্য প্রয়াস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
একথা আজ নিঃসংশয়েই বলা যায় যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য শাশ্বত রসমূল্যের দিক থেকে ঐশ্বর্যহীন সমসাময়িক যুগকে অতিক্রম করে তিনি কাব্যরসধারা যুগান্তরে প্রবাহিত করে দিতে পারেন নি। তিনি বিশেষ যুগেরই কবি, নিত্যকালের কবি নন। তবুও একটি যুগকে যে কবি কাব্যরসধারায় পরিতৃপ্ত করে গেছেন ইতিহাসে তাঁর স্থান তুচ্ছ নয়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যকৃতি সাহিত্যের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।