ভারতচন্দ্র রায়ের পরবর্তীকাল থেকে ঈশ্বরচন্দ গুপ্ত (Ishwar Chandra Gupta; ১৮১২-১৮৫৯) মহাশয়ের আবির্ভাবকাল পর্যন্ত যা কিছু রচিত হয়েছে, তাতে কবিগানে বা জনরঞ্জক অন্যান্য গীতি কবিতায় প্রাচীন ধারার জের টানা হয়েছে। এই শতাব্দীকাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যুগসন্ধিকাল রূপে চিহ্নিত। মধ্যযুগ অতিক্রান্ত অথচ তার শেষটুকু বর্তমান, আধুনিক যুগ অনাগত তবু নানা দিক্ থেকে তাঁর আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। নতুন একটি সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করা যাচ্ছে, অথচ তাকে ধরা যাচ্ছে না। এমনি একটি আলো-আঁধারী যুগ বাংলার সাধারণ মানুষকে তার সাহিত্য-রস-পিপাসা নিবৃত্তির উপায়-স্বরূপ মেনে নিতে হয়েছিল কবি, তর্জা, পাঁচালী, খেউড়, টপ্পা প্রভৃতি নিম্নরুচির পরিচায়ক বিভিন্ন রচনাকে। এইসব রচনায় যেটুকু অভিনবত্ব চোখে পড়ে তা নিতান্তই চটুল ভঙ্গিসর্বস্ব, প্রাণশক্তির দৈন্য তার মধ্যে প্রকট। ইতিমধ্যে বাংলার নতুন সংস্কৃতিকেন্দ্ররূপে কলকাতা নগরী সর্বময় প্রাধান্য অর্জন করেছে। দীর্ঘদিনের ইংরেজ শাসনজনিত একটি স্পষ্ট পরিবর্তন সমাজের সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে নতুন ও পুরনো ভাবধারার সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সাহিত্য-কর্মীদের মধ্যে এক বাস্তব জীবনাগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। এই আগ্রহটা সম্পূর্ণ নতুন এবং আধুনিক মানসিকতার প্রধান লক্ষণ।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কাঁচরাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রামে বড় হয়েছেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকে কবির দলের জন্য গান রচনা করতেন। এইভাবে তাঁর কবিত্বশক্তির উন্মেষ হয়। বলা বাহুল্য তাঁর ব্যক্তিত্বে পাশ্চাত্ত্য প্রভাব পড়েনি, দেশজ সংস্কৃতির মৃত্তিকা তাঁর প্রধান আশ্রয় ছিল। তিনি ছিলেন পূর্বকথিত যুগসন্ধিকালের কবি, যাঁর বিচিত্র রচনায় যুগধর্মের নানা দিক বিকশিত হয়ে উঠেছে।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কলকাতার উত্তরঙ্গ এবং বিচিত্র পথে ধাবিত জীবনের মুখরতার মধ্যে যখন এসে দাঁড়ালেন তখন খুব সম্ভব স্বাভাবিকভাবে এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে নিতে পারেন নি। আধুনিক জীবনের প্রতি সন্দেহ ও সংশয় এরূপ মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কোনদিনই ঈশ্বর গুপ্ত সে সংশয় থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার বিরূপপরায়ণতার মূল নিহিত আছে সংশয়বোধে। তিনি সতর্ক সমালোচকদের দৃষ্টিতে সমসাময়িক জীবনকে দেখেছেন। অথচ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকরূপে দ্রুত রূপান্তরশীল আধুনিক জীবনের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। কলকাতার সমাজের একজন প্রধান পুরুষরূপে শিক্ষা ও সংস্কারমূলক নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁকে জড়িত হতে হয়েছে। তিনি বুঝেছেন, ভাল-মন্দ মিশ্রিত নতুন যুগ একটি বাস্তব সত্য, এবং সত্যকে স্বীকার না করে কোন উপায় নেই। এইভাবে একই সঙ্গে প্রাচীনের প্রতি মমত্ববোধ ও প্রাচীন জীবনের মূল্যবোধগুলি অবসিত হয়েছে দেখে ঈশ্বর গুপ্তের মনে বেদনা এবং অন্যদিকে কর্মসূত্রে আধুনিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে জীবনের প্রগতি ধারাকে বোঝাবার চেষ্টা—এই দুই বিপরীত বৃত্তি একত্রে কাজ করতো। তিনি যে সমাজে যে কালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন— সেই পটভূমিতে এই দোটানা একান্তই স্বাভাবিক।
কবিগান ও হাফ-আখড়াই-এর কবিরা কলকাতার অপরিমার্জিতরুচি শ্রোতাদের তৃপ্তির জন্য যে চটুল, শালীনতাহীন কাব্য রচনা করতেন, তার পটভূমিতে দেখলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় বুদ্ধিদীপ্ত, বস্তুনিষ্ঠ মননভঙ্গির প্রকাশকে অবশ্য নিঃসন্দেহেই নতুন কাব্যরীতির ইঙ্গিতবহ বলে মনে হয়। তিনি খণ্ড খণ্ড গীতিকবিতা রচনা করতেন। এই কবিতা ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এইসব কবিতায় বিষয় হিসাবে নীতিবাদ, সামাজিক রীতিনীতির সমালোচনা, খাদ্য বস্তুর বর্ণনা এবং সমসাময়িক বহু ঘটনা ব্যবহৃত হয়েছে। বিষয় যাই হোক, সর্বত্র তাঁর বুদ্ধির আলোকে উজ্জ্বল ব্যঙ্গপ্রবণ মনের প্রকাশে কবিতাগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাটি তাঁর তীক্ষ্ম ব্যঙ্গের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
“তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গোরু,
শিখিনি শিং বাঁকানো।
কেবল খাব খোল বিচিলি ঘাস।
যেন রাঙা আমলা, তুলে মামলা,
গামলা ভাঙে না।
আমরা ভূষি পেলেই খুশি হব,
ঘুসি খেলে বাঁচব না।”
অকৃত্রিম খাঁটি বাংলা ভাষার ওপরে ঈশ্বর গুপ্তের অপরিসীম অধিকার ছিল। তিনি সেই ভাষাকে আবশ্যক মতো পরিমার্জিত করে নিয়েছেন। তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য—বস্তুনিষ্ঠ জীবন পর্যবেক্ষণ, সুস্থ জীবনাগ্রহ এবং বিদ্রূপাত্মক মনোভঙ্গির প্রকাশ। জীবনের প্রতি তিনি কখনও বিমুখ ছিলেন না। জীবনের তুচ্ছ দিকগুলির প্রতিও তাঁর আগ্রহের অন্ত নেই। আনারস, তপসে মাছ বা পাঁটা-প্রশস্তি, পৌষ-পার্বণের বর্ণনা—প্রভৃতি কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং তীব্র কৌতুক-প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘কষিতকনক কান্তি, কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁফ দাঁড়ি, তপস্বীর প্রায়।’
‘পাঁটা-প্রশস্তি’ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন’—
“রসভরা রসময়, রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি, হয়েছি পাগল।।
তুমি যার পেটে যাও, সেই পুণ্যবান।
সাধু সাধু সাধু তুমি, ছাগীর সন্তান।।
মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?
যত চুষি তত খুসি হাড়ে হাড়ে রস।।
তাঁর গভীর বিস্তৃত সমাজ-চেতনা এবং স্বদেশপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় নীলকর বা মাতৃভাষা মাতৃভূমি সম্পর্কে রচিত কবিতাগুলিতে। বাঙালী জীবনের তুচ্ছ ও মহৎ সমস্ত কিছুর প্রতিই তাঁর অকৃত্রিম আকর্ষণ ছিল।
এই বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ, ভাবালুতাবর্জিত বুদ্ধির আলোকে জীবনকে বোঝাবার চেষ্টা—বাংলা কাব্যে একান্তভাবে নতুন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মানসিকতার বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই বাংলা কাব্যে তিনি একটি নতুন স্বাদ আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইভাবে তাঁর কবিতায় আধুনিকতার লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সচেতন সাহিত্যিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন লেখক। আপন কালের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করার সচেতন প্রয়াস এবং সাহিত্যিক দায়িত্ববোধে তাঁর ব্যক্তিত্বে আধুনিকতারই লক্ষণ পরিস্ফুট। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রথাসিদ্ধ খাদ্য-বর্ণনাত্মক কবিতা লিখেছেন, কবিওয়ালাদের অনুপ্রাস যমকে পূর্ণ কাব্যরীতি অনুসরণ করেছেন, ভাবে-ভাষায় তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই প্রাক্-আধুনিক যুগের সাহিত্যিক মেজাজটা অনুভব করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন, “যে ভাষায় তিনি পদ্য লিখিয়াছেন এমন খাঁটি বাংলায়, এমন বাঙালীর প্রাণের ভাষায়, আর কেহ পদ্য কি গদ্য কিছুই লেখেন নাই। তাহাতে সংস্কৃতিজনিত কোন বিকার নাই—ইংরেজীনবিশী বিকার নাই। পাণ্ডিত্যের অভিমান নাই—বিশুদ্ধির বড়াই নাই। ভাষা হেলে না, টলে না, বাঁকে না—সরল সোজা পথে চলিয়া গিয়া পাঠকের প্রাণের ভিতরে প্রবেশ করে।” কিন্তু তাঁর কবিতাগুলিতে সমাজ বাস্তবতার প্রতি, প্রত্যক্ষ জীবনের প্রতি যে আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে—তা একান্তভাবে আধুনিক মানসিকতার লক্ষণ। এজন্য শেষ বিচারে তাঁকে একান্তভাবে প্রাচীন কাব্যধারার কবি বা একান্তভাবে আধুনিক কালের কবি—কোনটিই বলা যায় না। তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের, এক ক্রান্তিকালের সংশয়িত জীবনচেতনার ভাষ্যকার বলাই সঙ্গত।
প্রধানতঃ ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক এবং অন্যতম লেখকরূপে খ্যাত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অপর সাহিত্যকীর্তিও কম উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁর জীবিত কালে প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে — (১) কবিবর রামপ্রসাদ সেনের ‘কালীকীর্তন’ (১৮৩৩), (২) ‘কবিবর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত’ (১৮৫৫) ও (৩) ‘প্রবোধ প্রভাকর’ (১৮৫৮)। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘হিতপ্রভাকর’ (১৮৬১) ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটক (১৮৬৩), এবং ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ (১৯১৩)। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রভৃতির জীবনী ও কাব্যগুলি সঙ্কলনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন প্রাচীন সাহিত্যকে সমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছেন, অপরদিকে তেমনি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র-আদি নবযুগের সাহিত্যিকদের পাদপ্রদীপের সামনে এনে দিয়ে নতুন যুগ সৃষ্টির পথ সুগম করে দিয়েছেন।