গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাটক এবং অভিনয়-শিল্পকে বাংলাদেশের আধুনিক সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত করেন। কলকাতা শহরে ধীরে ধীরে অনেকগুলি রঙ্গমঞ্চ গড়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অভিনয়-কলা বিষয়ে আগ্রহ ক্রমবর্ধমান হওয়ায় রঙ্গালয়ের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হতে থাকে। অনেক রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নিয়মিত অভিনয়ের জন্য নতুন নতুন নাটকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক লেখক নাট্য রচনায় উদ্যোগী হন। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (Kshirode Prasad Vidyavinode) এরূপ একটি অনুকূল পরিবেশের সহায়তা লাভ করায় লেখক হিসেবে খুব উঁচুদরের প্রতিভার অধিকারী না হওয়া সত্ত্বেও সহজেই নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পেরেছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের সময় থেকে বাংলা রঙ্গমঞ্চে যে সব নাটক সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হত সেগুলোকে মোটামুটিভাবে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করে দেখা যায়— (১) পৌরাণিক নাটক; (২) ঐতিহাসিক নাটক; (৩) সামাজিক নাটক; (৪) নৃত্যগীতমুখর রঙ্গনাট্য। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ বাংলাদেশের অভিনয় জগতে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন উপরিউক্ত চার শ্রেণীর নাটক লিখে। এর মধ্যে ‘আলিবাবা’ প্রভুত সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন অভিনীত হয় এবং রঙ্গালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টি ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ক্রমে তিনি অন্যান্য শ্রেণীর নাটক রচনাতে হস্তক্ষেপ করেন।
ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘সাবিত্রী’ (১৯০২), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৩), ‘মান্দাকিনি’ (১৯২১), ‘চাঁদবিবি’ (১৯০৭) এবং ‘নরনারায়ণ’ (১৯২৬)। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে অলৌকিকতা এবং ভক্তিরসের উচ্ছ্বাসময় যেসব নাটক রচনা করেছিলেন তার জনপ্রিয়তা ছিল অসাধারণ। স্বভাবতঃই এই ধরনের নাটকের চাহিদা ছিল প্রচুর। ক্ষীরোদপ্রসাদ পৌরাণিক নাটকে গিরিশচন্দ্রের ধারার অনুবর্তন করেন। তবে তিনি পৌরাণিক নাটকে অলৌকিকতা এবং ভক্তিরসের সঙ্গে প্রধান চরিত্রগুলির পরিণত রূপ চিত্রণে অনেক পরিমাণে দ্বন্দ্বময় নাট্যপরিস্থিতির ওপরে নির্ভর করেছেন। ঘটনাগত সংঘাত এবং চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের ওপরে জোর দেওয়ায় পৌরাণিক চরিত্রগুলির মধ্যে এক ধরনের বাস্তব গুণ পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। ‘ভীষ্ম’ নাটকের ভীষ্ম চরিত্র এবং ‘নরনারায়ণ’-এর কর্ণ চরিত্র এইদিক থেকে ক্ষীরোদপ্রসাদের বিশিষ্ট সৃষ্টি।
ক্ষীরোদপ্রসাদ ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নাটক রচনা করেন। এই শ্রেণীর নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নন্দকুমার’ (১৯০৮), ‘বঙ্গের প্রতাপ-আদিত্য’ (১৯০৬), ‘পদ্মিনী’ (১৯০৭), ‘গোলকুন্ডা’ (১৯২৫) এবং ‘আলমগীর’ (১৯২১)। ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অবলম্বন করলেও এসব নাটকে ক্ষীরোদপ্রসাদ ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন নি। স্বাদেশিক আন্দোলনের আবেগ এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবার আগ্রহে প্রতাপাদিত্যকে তিনি জাতীয় বীররূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রয়োজনবোধে পূর্বাপর সঙ্গতিহীনভাবে কাল্পনিক ঘটনা উদ্ভাবন করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। ‘আলমগীর’ নাটকে তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আদর্শ প্রমূর্ত করে তোলবার প্রেরণায় যথেচ্ছভাবে ঘটনাবিন্যাস করেছেন। তিনি নাটক রচনার জন্য যে সব তথ্যের সমাবেশ করতেন তা শিল্পসম্মতভাবে নাটকে রূপ দেবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। অবশ্য ‘আলমগীর’ নাটকে ঔরঙ্গজেব চরিত্রের দ্বন্দ্বদীর্ণ ব্যক্তিত্ব চিত্রণে তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রঙ্গমঞ্চের চাহিদার প্রতি যতটা নজর রেখে লেখনী চালনা করেছেন নাটকের সাহিত্যিক উৎকর্ষ বিষয়ে ততটা সচেতন ছিলেন না। এই কারণে রঙ্গমঞ্চে তাঁর নাটকগুলি বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হলেও তিনি সাহিত্যের ভাণ্ডারে কিছু স্থায়ী কীর্তি রেখে যেতে সমর্থ হন নি।