মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt, ১৮২৪-১৯৭৩) বাংলা কাব্য সাহিত্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম বড়ো পরিবর্তন করেছিলেন। মধুসূদন দত্তের সাহিত্য জীবনের বিস্তার খুব বেশী নয়। তাঁর সাহিত্যচর্চার প্রধান পর্ব ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাদ্রাজ প্রবাস থেকে বাংলাদেশে কবি যখন প্রত্যাবর্তন করেন—সেই সময়ে বাংলার নবগঠিত সারস্বত সমাজের কাব্য-রস-পিপাসা-নিবৃত্তির উপকরণ ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতার পরিহাস-রসিকতা এবং রঙ্গলালের ভাবাতিরেকে আক্রান্ত রোমান্টিক কবিতা। সাহিত্যরুচির ক্ষেত্রে তখন নতুন হাওয়া বইছিল, কিন্তু নবযুগের ভাবপ্রেরণা আত্মস্থ করে যথার্থভাবে নতুন কাব্য-কলা সৃজনের উপযুক্ত প্রতিভার তখনও প্রকাশ হয়নি। মধুসূদন দত্ত এই সম্ভাবনাপূর্ণ অথচ অগঠিত একটি সাহিত্যিক আবহাওয়ায় কাজ শুরু করেন।
উচ্চাভিলাষী যুবক মধুসূদন দত্ত পাকা সাহেব হবার বাসনায় একান্তভাবে ইউরোপমুখী হয়েছিলেন। বাইরের দিক থেকে স্বদেশের প্রতি উপেক্ষাই তাঁর সকল আচার-আচরণে প্রকট ছিল। সুতরাং মাতৃভাষায় নতুন-কিছু সৃষ্টি করা যে তাঁর পক্ষে সম্ভব একথা তখনকার সাহিত্যিক সমাজের কারও পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। রামনারায়ণের সংস্কৃত থেকে অনুবাদ নাটক ‘রত্নাবলী’ ইংরেজীতে অনুবাদ করে দেবার জন্যে তাঁকে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর আহ্বান জানান। এই যোগাযোগ বাংলা সাহিত্যে এক দুর্লভ প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে বিতর্ক-প্রসঙ্গে মধুসূদন দত্ত বাংলায় অমিত্রাক্ষর রচনার প্রতিজ্ঞা করেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে দেশের সাহিত্যিক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। বাজি রেখে অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝোঁকে মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ সম্পূর্ণ করেন। ইতঃপূর্বেই তিনি ‘পদ্মাবতী’ নাটকে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করে তার শক্তি পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যে মধুসূদন দত্তের কবিজীবনের সূচনা, এই কাব্যেই বাংলা কবিতায় আধুনিক যুগেরও সূচনা।
তিলোত্তমাসম্ভবঃ মধুসূদন দত্ত সুন্দ-উপসুন্দ নিধনের জন্য অপরূপ রূপলাবণ্যবতী তিলোত্তমা সৃষ্টির পৌরাণিক কাহিনী ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যে ব্যবহার করেছেন। নতুন ছন্দ সৃষ্টির প্রতি কবির আগ্রহ প্রবল হওয়ায় কাহিনী-বিন্যাস এবং গঠনের দিক থেকে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ অনেকাংশে অসম্পূর্ণ রচনা। দেবচরিত্রগুলির পরিকল্পনায় এবং এক সর্বাতিশায়ী দৈবশক্তির কল্পনায় মধুসূদন দত্ত কিছু পরিমাণে গ্রীক কাব্যের অনুসরণ করলেও পুরানো কাহিনিটিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন নি। তিলোত্তমাসম্ভবে একটি আখ্যানধারা আছে, কিন্তু সেই আখ্যানকে মহাকাব্যোচিত সংহত আকার দেওয়া হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে এক-একটি বর্ণনা, বিশেষভাবে নিসর্গ বর্ণনাগুলিতে কবির রোমান্টিক প্রবণতা এবং লিরিক ভাবোচ্ছাসে যথার্থ নতুন কাব্যরসের স্বাদ পাওয়া যায়। এই কাব্যের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দুটিঃ (১) অমিত্রাক্ষর ছন্দে পূর্ণাঙ্গ কাব্য রচনার এই প্রথম প্রয়াস। (২) ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী বিন্যাসে পাশ্চাত্ত্য কাব্যের বর্ণনা-পদ্ধতি এবং পাশ্চাত্ত্য জীবন-ভাবনার মিশ্রণ।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ: মৌলিক প্রতিভাসম্পন্ন কোন কবিই অন্ধভাবে প্রচলিত কাব্যকলার অনুবর্তন করেন না। আপন জীবন-ভাবনালব্ধ সত্য এবং আপন কল্পনার জগৎটিকে প্রকাশের জন্য নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা তাঁকে নির্মাণ করতে হয়। বাণীর নতুন রূপ সৃষ্টি মৌলিক প্রতিভার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। আধুনিক কালের কবি মধুসূদন দত্তের পক্ষে রূপান্তরিত জীবন-চেতনা প্রকাশের জন্য নতুন কাব্যভাষা এবং নতুন আঙ্গিক উদ্ভাবন অপরিহার্য ছিল। আত্মপ্রকাশের দুরন্ত আগ্রহে কবি প্রাচীন ছন্দের বন্ধন ভেঙে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণ করেছেন। মধুসূদন দত্তের এই প্রয়াসে বাংলা কাব্যে ছন্দোমুক্তির সূচনা হয়। আট এবং ছয় মাত্রার দুটি পর্ব একই সঙ্গে অর্থগত ভাগ এবং শ্বাসগত ভাগরূপে পরিগণিত হত। সুতরাং এই ছন্দে ছেদ এবং যতি পড়ত একই স্থানে। মধুসূদনের ছন্দের দৃশ্যত বড়ো বৈশিষ্ট্য দুই চরণের মধ্যে চরণাস্তিক মিলের অভাব, কিন্তু এটিই অমিত্রাক্ষরের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। প্রধান বৈশিষ্ট্য ছেদ ও যতি স্থাপনের নতুন পদ্ধতি। মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষরে শ্বাসগত বিভাগ প্রাচীন পয়ারের মতোই আট এবং ছয় মাত্রার দুটি পর্বে, কিন্তু অর্থের দিক থেকে এইভাবে পর্ব ভাগ করা যায় না। চরণ অতিক্রম করেও বক্তব্য-ধারা অন্য চরণে সংক্রমিত হতে পারে। এককথায় বলা চলে, এই ছন্দে তিনি ছেদ ও যতির বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ভাবকে দিলেন ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি, ফলে ছন্দও হলো প্রবাহমান। বস্তুতঃ এই কারণে অমিত্রাক্ষর ছন্দকে ‘প্রবহমান’ ছন্দ বলে অভিহিত করা হয়। ফলে একটি ভাব দুটি চরণের পয়ারের মধ্যেই সম্পূর্ণ করবার বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন,
“কিন্তু মায়াময়ী মায়া, বাহু প্রসারণে
ফেলাইলা দূরে সবে, জননী যেমতি
খেদান মশকবৃন্দে সুপ্ত সুত হতে
করপদ্ম সঞ্চালনে!”
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল শক্তি এই নতুন বিন্যাস রীতিতেই নিহিত। মিলের অভাবজনিত শূন্যতা কবি পূর্ণ করেছেন সুনির্বাচিত শব্দপ্রয়োগে সৃষ্ট ধ্বনির বিচিত্রতা দ্বারা। লঘু ও গুরু শব্দের সংঘাতে এই কবিতায় এমন ছন্দোসঙ্গীত সৃষ্টি হয়—যার ফলে মিলের অভাব অনুভূতই হয় না। “তিলোত্তমাসম্ভব” কাব্যে এই ছন্দ অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। “মেঘনাদবধ” কাব্যেই অমিত্রাক্ষর ছন্দের বিচিত্রতর ব্যবহার দেখা যায়। “বীরাঙ্গনা” কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের নমনীয়তা এবং সৌন্দর্যের চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
মেঘনাদবধ কাব্য: মধুসূদন দত্তের বিশিষ্ট প্রতিভার শক্তি পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে “মেঘনাদবধ কাব্যে” (১৮৬১)। “তিলোত্তমাসম্ভব”য় কাব্যভাষা এবং কাব্যের ছন্দ বিষয়ে কবি যে পরীক্ষার সূচনা করেছিলেন, পরীক্ষামূলকতার স্তর অতিক্রম করে তা মেঘনাদবধ কাব্যে নতুন সৃষ্টির প্রাণোন্মাদনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধের বিরাট পটভূমির মধ্যে নানা ধরনের চরিত্র এবং নানা রসের সমাবেশ ঘটেছে। অনুভূতির বিচিত্রতা এবং আবেগের ভিন্ন ভিন্ন স্তর এই কাব্যে কবি অমিত্রাক্ষরের মাধ্যমে অনায়াসে প্রকাশ করেছেন। তিনি দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সর্ববিধ প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু শুধু ভাষা ও ছন্দের জন্যেই নয়, মর্মগত বক্তব্যের জন্যেও মেঘনাদবধ বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সম্পূর্ণ এক নতুন সৃষ্টি। ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে আবহমান কাল ধরে সমাদৃত রামায়ণ কাহিনী থেকে মধুসূদন দত্ত এই কাব্যের কাহিনী সংগ্রহ করেছেন; ভারতীয় সমাজের নীতি-চেতনা, ধর্মবোধ, গার্হস্থ্য-বন্ধন প্রভৃতি যে আদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রামায়ণে সেই আদর্শকেই রূপ দেওয়া হয়েছিল এবং এই জীবন-নীতির বিরোধী যা কিছু—তাই প্রতিফলিত রামায়ণের রাবণ চরিত্রে। মধুসূদন দত্ত মধ্যযুগীয় জীবনাদর্শের বিরুদ্ধে আধুনিক জীবন-চেতনায় দীপ্ত ব্যক্তি-মানুষের মহিমা বড়ো করে দেখাবার জন্যে এই ধর্মদ্রোহী রাবণকেই তাঁর কাব্যে নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন এবং রাবণ ও তার পক্ষভুক্ত বীরদের চরিত্র উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করেছেন। যে রামচন্দ্র প্রতি পদক্ষেপে নীতিশাস্ত্রের সূত্র মিলিয়ে চলেন তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে নবযুগের কবি আত্মশক্তির বলে বলীয়ান অসীম শক্তিধর স্পর্ধিত রাবণকেই কাব্যে প্রাধান্য দিয়েছেন। রাবণ চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলাতেই কবি আনন্দবোধ করেছেন। এই রাবণ একদিকে অমিত বলবীর্যশালী—অন্যদিকে স্নেহে-প্রেমে মমতায় পূর্ণ হৃদয় নিয়ে মানবতার আদর্শ বিগ্রহ। যে মানবতাবাদ ইউরোপ থেকে সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশের উনিশ শতকের জীবন চেতনায় এই নবজাগরণ সম্ভব করে তুলেছিল, মেঘনাদবধ কাব্যে সর্বপ্রথম সেই নতুন জীবনাদর্শের রূপায়ণ দেখা গেল। মেঘনাদবধ কাব্যে ভাব ও রসের ক্ষেত্রে অতি সচেতনভাবে যে পরিবর্তন ঘটানো হল, প্রাচীন ধর্ম ও নীতি-শাসিত জীবনের পরিবর্তে আত্মশক্তি নির্ভর অটল ব্যক্তিত্বে উন্নতশির মানুষের মহিমা মূর্ত করে তোলা হল—তাতেই যথার্থভাবে আধুনিক কাব্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিষয়বস্তু এবং কাব্যকলা—উভয়দিক থেকেই মেঘনাদবধ আধুনিক শিল্পবোধসম্পন্ন কবির মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেয়। নতুন ছন্দ ও রূপান্তরিত ভাষার প্রয়োগে, সুপরিকল্পিতভাবে কাহিনী বিন্যাসে, সংহত কাব্যকায়া নির্মাণের দক্ষতাতে মধুসূদন দত্ত এই কাব্যে আধুনিক কবিদের সামনে কবিতার শিল্পরূপ সৃষ্টির দায়িত্ব সম্পর্কে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। ‘মেঘনাদবধ’ আধুনিক যুগের প্রথম বাংলা কাব্য এবং বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র সার্থক মহাকাব্য।
ব্রজাঙ্গনা কাব্য: ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য মধুসূদনের কবি খ্যাতির প্রধান অবলম্বন হওয়ায় তিনি মহাকাব্যের কবিরূপে পরিচিত। মেঘনাদবধের মহাকাব্যোচিত সমারোহের মধ্যেও মাঝে মাঝে গীতিরস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গে সীতার বিলাপে, রাবণের আর্তস্বরে মধুসূদনের প্রকৃতিগত রোমান্টিক লিরিক মানসপ্রবণতা প্রকাশ পায়। তার কবি মানসের লিরিক-প্রবণতার জন্যে মেঘনাদবধ রচনার সঙ্গে সঙ্গে রাধার বিরহ প্রসঙ্গ নিয়ে কাব্য রচনার প্রেরণা তিনি অনুভব করেছিলেন। বৈষ্ণব কাব্যের রোমান্টিক পরিবেশ এবং রোমান্টিক প্রেমের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা কাব্যে নতুন ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বৃহৎ কাব্যগ্রন্থগুলির পাশে খণ্ড খণ্ড গীতি-কবিতার এই সংকলনটি তেমন মর্যাদা পায়নি, তবুও ব্রজাঙ্গনার কবিতাগুলি ভাষা ছন্দের পরীক্ষার দিক থেকে আকর্ষণীয়। দেশজ ভাষার ছন্দস্পন্দ যে মধুসূদনের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য তার প্রমাণ।
“কেন এত ফুল তুলিলি, সজনি—
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে, পরে কি রতনে
তারার মালা?
আর কি যতনে কুসুম রজনী
ব্রজের বালা?”
মেঘনাদবধ রচনার সমসময়ে ব্রজাঙ্গনায় মধুসূদন স্বাচ্ছন্দ্যময় লিরিক লিখেছেন। খাঁটি বাংলা ভাষার ছন্দস্পন্দ যে তাঁর মজ্জাগত উদ্ধৃত অংশটিতে তা প্রমাণিত হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বিচিত্র ব্যবহার, কবিতার গঠনে, যদি সংখ্যা এবং চরণ সংখ্যা বিন্যাসের অপরিসীম স্বাধীনতায় ব্রজাঙ্গনার কবিতাগুলি বাংলা কবিতার আঙ্গিকগত পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে ‘ওড’ (Ode) জাতীয় গীতিকাব্য-রূপে অভিহিত করা হয়।
বীরাঙ্গনা কাব্য: “বীরাঙ্গনা কাব্য” (১৮৬২) ওভিদের ‘হেরোইদাস’ কাব্যের অনুকরণে রচিত পত্রকাব্য। ওভিদের কাব্যে একুশখানি পত্র আছে, মধুসূদনেরও পরিকল্পনা ছিল একুশ স্বর্গে বীরাঙ্গনা কাব্য সম্পূর্ণ করার। কিন্তু মাত্র একাদশটি পত্রের সংকলন রূপে এই কাব্য প্রকাশিত হয়। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী থেকে এগারটি নায়িকা চরিত্র নির্বাচন করে প্রেমাস্পদের উদ্দ্যেশে নায়িকাদের পত্রের আকারে এই কাব্যের এগারটি সর্গ রচিত হয়েছে। প্রতিটি স্বর্গই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কাব্যটির সাধারণ বিষয় প্রেম। কিন্তু এক একটি নারী চরিত্রের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের আধারে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রেমের রূপ স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। চরিত্র এবং চরিত্রগত সমস্যার বিচিত্রতার ফলে হৃদয়াবেগের স্তরগুলি সর্বত্র এক নয়, কিন্তু মধুসূদনের ভাষা ও ছন্দ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিষয়ের উপযুক্ত আধার হয়ে উঠেছে। বীরাঙ্গনার পত্রিকাগুলিতে এক একটি আখ্যানের ক্ষীণ আভাস আছে, প্রতিটি সর্গই বিশেষভাবে চরিত্রগুলির উক্তিরূপে রচিত। তথাপি তার মধ্যে আখ্যান-কাব্যের নয়, গীতিকাব্যের ধর্মই বেশি পরিস্ফুট হয়েছে। প্রতিটি সর্গে একটি স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবের প্রকাশ হওয়ায় বস্তুত সর্গগুলি খণ্ড খণ্ড গীতিকাব্যের রূপ ধারণ করেছে। আর এই কাব্যে মধুসূদন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’কে সপ্তম্বরা বাঁশীর মতো ব্যবহার করেছেন। তাতে বীর, করুণ, বীভৎস, বিভিন্ন রসের সার্থক সৃষ্টি করেও মধুসূদন এর দ্বারা গীতি কবিতাসুলভ মধুর রস সৃষ্টিতেই অধিকতর সার্থকতা দেখিয়েছেন। এই বিষয়ে মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য একসুত্রে গ্রথিত। ‘বীরাঙ্গনা’র ভাষাকেও গীতিকাব্যের আদর্শ ভাষা বলা যায়। আবার ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে নায়িকাদের উক্তিতে যে নাটকীয়তার প্রকাশ ঘটেছে তার ফলে অনেকেই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য টিকে ‘নাটকীয় একোক্তি’ (Dramatic Monologue) নামে অভিহিত করে থাকেন।
সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাবলী: চতুর্দশপদী কবিতাবলী বা সনেট সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। সনেট বস্তুত গীতিকবিতার একটি প্রকারভেদ। বাংলায় পাশ্চাত্ত্য কাব্যকলা আত্মীকরণের ঝোঁক মধুসূদনের কবিজীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবি-জীবনের প্রথম পর্বেই তিনি সনেট রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম সনেটটির রচনাকাল মেঘনাদবধ কাব্যের সমসাময়িক। কিন্তু এর পরে কবি দীর্ঘদিন এই কাব্যরূপটির চর্চা করেন নি। ইউরোপ প্রবাসকালে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই শহরে কবি যখন বাস করছিলেন তখনই সনেটগুলি রচনা করেন। প্রবাসে দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যে কবির ক্লিষ্টচিত্ত । স্বদেশের জন্যে, দেশের কাব্য-সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্যে যে ব্যাকুলতা অনুভব করত এই খণ্ড খণ্ড কবিতায় তাই যথাযোগ্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে ব্যক্তি-মানুষ মধুসূদনের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। আখ্যান নয়, চরিত্রসৃষ্টির আগ্রহ নয়, একান্তভাবে কবির নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি প্রত্যক্ষভাবে সনেট গুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। ইতালীয় কবি পেত্রার্ক-কর্তৃক অনুপ্রাণিত হলেও মধুসূদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল্টনের রীতি অনুসরণ করেছেন।
মধুসূদনের কবি জীবনের বিস্তার খুব বেশী নয়। তিনি কবিজীবনে মাত্র কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে বাংলা কবিতায় আবহমান ধারায় মৌলিক রূপান্তর সাধন করে গেছেন। তিনি বাংলা কবিতায় বিশ্ব-কাব্যলোকের উন্নততর আদর্শ এবং রুচির প্রবর্তন করেন। ধর্মীয় জটিলতা এবং অতিলৌকিকতায় আচ্ছন্ন বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে মানবিক অনুভূতির বিচিত্রতা ও মানবমহিমাকে কাব্যবিষয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ মুক্তিপথ প্রস্তুত করে দিয়েছেন। কবিতার ভাব ও রসের ক্ষেত্রে যেমন তিনি বিপ্লব সাধন করেছেন তেমনই এই নতুন ভাববস্তু উপযুক্ত আধার রচনার জন্য প্রাচীন বাংলা কাব্যের প্রকাশরীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন কাব্য আঙ্গিক উদ্ভাবন করেছেন। সুতরাং মধুসূদন থেকেই বাংলা কাব্যের আধুনিক যুগের সূচনা—এই উক্তিতে একটি তর্কাতীত ঐতিহাসিক সত্যই বিঘোষিত হয়েছে বলা যায়।