দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে পল্লবরা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকে নবম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। দক্ষিণ ভারতে পল্লব রাজবংশ আনুমানিক 275 খ্রিস্টাব্দ থেকে 891 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
পল্লব যুগের রাজনীতি (Politics)
দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রতিপত্তিশালী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে পল্লবরা দক্ষিণ ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের উপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। তামিল রাজ্যগুলির মধ্যে পল্লবরাই প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাঁরা তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণে প্রথম রাজধানী গড়ে তোলার কৃতিত্ব অর্জন করে। দক্ষিণ ভারতের প্রায় সব রাজবংশগুলিই পল্লবদের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছিল। সাতবাহনদের পর দক্ষিণ ভারতের অপর কোনও শক্তি তাঁদের মতো প্রতিপত্তিলাভে সক্ষম হয় নি। উত্তরে নর্মদা ও উড়িষ্যার সীমান্ত থেকে দক্ষিণে পেনার নদী এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে বেরার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর পল্লবদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র ভারত ভূখণ্ডেই নয়—ভারতের বাইরে সিংহলেও তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। চোলদের উত্থানের আগে পর্যন্ত নৌশক্তিতে দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে পল্লবরাই ছিল শ্রেষ্ঠ। তাদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় উপদ্বীপ ও সুমাত্রা অঞ্চলেও বিস্তৃত ছিল।
পল্লব যুগের সাহিত্য (Literature)
পল্লব রাজারা শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী কাঞ্চি বিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থী ও পণ্ডিতরা এখানে সমবেত হতেন। পল্লব রাজারা সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘কিরাতার্জনীয়ম্’ কাব্যের রচয়িতা কবি ভারবি পল্লব-রাজ সিংহবিষ্ণুর রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন। ‘কাব্যাদর্শ’ প্রণেতা দণ্ডিন দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের দরবারে আসেন। পল্লব-রাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মন একজন খ্যাতনামা লেখক ছিলেন। তিনি ‘মত্তবিলাস প্রহসন’ ও ‘ভগবদজ্জুকিয়’ নামে দুটি প্রহসন সংস্কৃতি ভাষায় রচনা করেন। রাজা নন্দীবর্মন-ও সুপণ্ডিত ছিলেন। বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও ‘ন্যায়ভাষ্য’ প্রণেতা বাৎস্যায়ন ছিলেন কাঞ্চির নাগরিক। পল্লব যুগে তামিল সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শৈব নায়নার ও বৈষ্ণব আলওয়ারদের রচিত ভক্তিমূলক গীতিগুলি তামিল সাহিত্যের পরিচয় বহন করে। প্রসিদ্ধ আলওয়ার সন্ত ও পণ্ডিত তিরুমঙ্গাই পল্লব যুগে আবির্ভূত হন।
পল্লব যুগের শিল্পকলা (Art)
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ইতিহাসেও পল্লব যুগ এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পল্লব রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পল্লব যুগের শিল্পকলার প্রভূত উন্নতি ঘটে। বস্তুতপক্ষে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে পল্লব রাজবংশের অধীনে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করে পল্লব শিল্পের বিকাশ ঘটে। রাজধানী কাঞ্চি, মহাবলীপুরম, আর্কট জেলা, ত্রিচিনোপল্লি প্রভৃতি স্থানে পল্লব যুগে বহু সুদৃশ্য মন্দির নির্মিত হয়। শিল্প-বিশেষজ্ঞ গ্রোসেট (Grousset) বলেন যে, পল্লব-শিল্পীরা শিল্পকর্মে এক নতুন রীতির বিকাশ ঘটান, যার উপর ভিত্তি করে দক্ষিণ ভারতের অপরাপর শিল্পরীতি গড়ে ওঠে। প্রকৃত দ্রাবিড় শিল্প ও ভাস্কর্যের প্রথম পরিচয়ও পল্লব শিল্প-ভাস্কর্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। পল্লব মন্দিরগুলি ছিল দু’ধরনের—(১) পাহাড় কেটে বৌদ্ধ বিহারের অনুকরণে বা রথের আকৃতিযুক্ত মন্দির এবং (২) স্বাধীনভাবে তৈরি মন্দির। পাহাড় কেটে মন্দির গঠনের পদ্ধতি সর্বপ্রথম পল্লবদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়।
প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের আমলে ত্রিচিনোপল্লি, চিঙ্গলপেট ও আর্কট জেলায় পাহাড় কেটে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর মন্দির নির্মিত হয়। প্রথম নরসিংহবর্মন রথের আকারে মন্দির নির্মাণ-রীতি প্রবর্তন করেন। গোটা পাহাড় বা পাথর কেটে মন্দিরের আকৃতি দেওয়া হত। মহাবলীপুরমের রথ-মন্দিরগুলির মধ্যে ধর্মরাজ রথ, দ্রৌপদী রথ, অর্জুন রথ ও ভীম রথ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের আমলে নির্মিত কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দির, বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দির, ত্রিপুরান্তকেশ্বর ও ঐরাবতেশ্বর মন্দির এবং মহাবলীপুরমের মুক্তেশ্বর মন্দির পল্লব মন্দির-স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এইসব মন্দিরের গঠন-সৌষ্ঠব, ভাস্কর্য কৌশল এবং মন্দির গাত্রে খোদাই করা মূর্তিগুলি দর্শকদের বিস্ময় উৎপাদন করে। মন্দিরগাত্রে অঙ্কিত গঙ্গাবতরণ বা গঙ্গার মর্তে আগমন এবং বিষ্ণুর অনন্ত শয়ান এই ধরনের দুটি বিখ্যাত ভাস্কর্য-কর্ম। এই মন্দিরগুলির অনুকরণে ভারতের বাইরে কম্বোজ, আন্নাম ও যবদ্বীপে মন্দির ও মূর্তি নির্মাণ করার রীতি শুরু হয়।
পল্লব যুগের ধর্ম (Religion)
পল্লব যুগে দক্ষিণ ভারতের আর্যীকরণ সম্পূর্ণ হয়। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণদের বসতিবিস্তার, মঠ-মন্দিরে তাঁদের বেদ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, মন্দির-সংলগ্ন ‘ঘেটিকা’ বা শিক্ষাকেন্দ্রগুলির ব্যয়ভার বহন দক্ষিণ ভারতে আর্য সংস্কৃতি বিস্তারে যথেষ্ট সহায়ক হয়। কাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বিস্তারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পল্লব রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পল্লব রাজ্যে পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শৈব নায়নার ও বৈষ্ণব আলওয়াররা দাক্ষিণাত্যে ভক্তি ধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলেন। পল্লব রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। পল্লব বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা সিংহবিষ্ণু ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। রাজা প্রথম মহেন্দ্রবর্মন প্রথমে জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পরে তিনি শিবের উপাসনা শুরু করেন। এ সত্ত্বেও অন্যান্য দেবদেবীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। পল্লব সাম্রাজ্যে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। হিউয়েন সাং দক্ষিণ ভারতে বহু বৌদ্ধ মঠ ও জৈন মন্দির দেখেছিলেন। পল্লব রাজত্বকালে দিগম্বর জৈনদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।