প্যারীচাঁদ মিত্রের (Peary Chand Mitra) বাংলা সাহিত্যচর্চার ইতিবৃত্ত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষারীতির সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা এবং একটি নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণের চেষ্টা প্যারীচাঁদ মিত্রের (টেকচাঁদ ঠাকুর) প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিন্দু কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্যারীচাঁদ মিত্র, তখনকার মনীষীদের তুলনায় কোনদিক থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। মনীষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর সৃজনক্ষম প্রতিভা। ভাষা বিষয়ে সচেতনতা এবং মৌলিক সৃষ্টিপ্রতিভা—প্যারীচাঁদ মিত্রের দুই বিশেষত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সর্বজনবোধগম্য ছিল না। দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে “সংস্কৃত বা ইংরেজী গ্রন্থের সার সংকলন বা অনুবাদ ভিন্ন বাংলা সাহিত্য আর কিছুই প্রসব করিত না। বাঙালী লেখকেরা গতানুগতিকের বাহিরে হস্ত প্রসারণ করিতেন না।” “এই দুইটি গুরুতর বিপদ হইতে প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধৃত করেন। যে ভাষা সকল বাঙালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙালী-কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন এবং তিনিই প্রথম ইংরেজী ও সংস্কৃতের ভাণ্ডারে পূর্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিষ্টাবশেষের অনুসন্ধান না করিয়া, স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান সংগ্রহ করিলেন। এক ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক গ্রন্থে এই উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল।”
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সহযোগিতায় ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়, এই পত্রিকায় “যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক।” অর্থাৎ কথ্যরীতির গদ্যই হবে এই পত্রিকার সমস্ত রচনার ভাষা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার সঙ্গে সাধারণ বাঙালী পাঠকদের পরিচয় সাধনের জন্য সাধারণ মানুষের ভাষায় প্রবন্ধাদি রচনার মাধ্যমে প্যারীচাঁদ মিত্র এইভাবে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন আবহাওয়া সৃষ্টি করলেন। এই পত্রিকাতেই তিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ধারাবাহিকভাবে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশ করেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস, স্বাধীন কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এবং কথ্যভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “উহাতেই প্রথম এ বাংলাদেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাংলা সর্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থ রচনা করা যায়। সে রচনা সুন্দরও হয় এবং যে সর্বজনহৃদয়গ্রহিতা সংস্কৃতানুযায়ী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এ ভাষার তাহা সহজ গুণ। এই কথা জানিতে পারা বাঙালী জাতির পক্ষে অল্প লাভ নহে, এবং এই কথা জানিতে পারার পর হইতে উন্নতির পথে বাংলা সাহিত্যের গতি অতিশয় দ্রুতবেগে চলিতেছে।” আলালের ঘরের দুলালের ভাষা আদর্শ ভাষা নয়। কিন্তু এই গ্রন্থেই প্রমাণিত হয় যে লেখক-প্রচলিত বাংলা ভাষা ও ভাব প্রকাশের দিক্ থেকে সংস্কৃত-নির্ভর ভাষার চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনার প্রভাবে পরবর্তী লেখকেরা সংস্কৃত রীতি এবং কথ্যরীতির গদ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করে আদর্শ গদ্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই কারণেই বাংলা গদ্যভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইটির গুরুত্ব অপরিসীম।
শুধু ভাষার দিক থেকে নয়, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসরূপে ঐতিহাসিক মর্যাদাসম্পন্ন রচনা। ইতিপূর্বে সামাজিক নকশা-জাতীয় রচনাগুলিতে (যেমন ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাস’) উপন্যাসের অস্পষ্ট পূর্বাভাস দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত উপন্যাস রচিত হয়নি। সমাজ পটে ব্যক্তি-চরিত্র স্থাপন করে একটি নির্দিষ্ট কাহিনীর বন্ধনের বাস্তব জীবনচিত্র পরিস্ফুট করা উপন্যাসশিল্পের প্রাথমিক দায়িত্ব, বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদই প্রথম সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে গড়ে ওঠা একটি নির্দিষ্ট, পূর্ণায়ত কাহিনী ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে উপস্থাপন করলেন। বড়লোকের আদুরে ছেলে মতিলালের পদস্খলন ও শেষে সৎপথে ফিরে আসা উপন্যাসটির মূল প্রসঙ্গ, ঘটনাগুলি মতিলালকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ঠকচাচা নামক চরিত্রটিই এই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ঠকচাচা উপন্যাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জীবন্ত সৃষ্টি; উহার মধ্যে কূট কৌশল ও স্তোকবাক্যে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া অসামান্য ক্ষমতার এমন চমৎকার সমন্বয় হইয়াছে যে, পরবর্তী উন্নত শ্রেণীর উপন্যাসেও ঠিক এইরূপ সজীব চরিত্র মিলে না। বেচারাম, বেণী, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম প্রভৃতি চরিত্রও কেহ বা অনুনাসিক উচ্চারণে, কেহ বা সঙ্গীতপ্রিয়তায়, কেহ বা কোন বিশেষ বাক্যভঙ্গীর পুনরাবৃত্তিতে—স্বাতন্ত্র্য অর্জন করিয়াছে।… কৃত্রিম সাহিত্যরীতি বর্জন ও কথ্যভাষার সরস তীক্ষ্ণাগ্রে প্রয়োগে ‘আলাল’-এর বর্ণনা ও চরিত্রাঙ্কন আরও বাস্তব রসসমৃদ্ধ হইয়াছে।”
প্যারীচাঁদ মিত্রের অন্যান্য রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘মদ-খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬০), উপন্যাস ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিক’ (১৮৮০)।