বাংলা কথাসাহিত্যে উপন্যাস ও ছোটগল্প রচয়িতাদের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২; Prabhatkumar Mukhopadhyay) বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। তিনি অনেকগুলি উপন্যাস রচনা করলেও মূলত ছোটগল্প-রচয়িতারূপে সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নৈপুণ্য, অন্তর্লোকচারী গভীর আবেগের ঘাত-প্রতিঘাত, জীবনের বিস্তার—প্রথম শ্রেণীর উপন্যাসের এই সমস্ত লক্ষণ তাঁর উপন্যাসে আমরা পাইনা, জীবনের দূরবগাহ ও জটিল দিকগুলির মর্মোদ্ঘাটনে তিনি বিশেষ উৎসাহ বোধ করেন নি। সে ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। কিন্তু আমাদের পারিবারিক জীবনের যে ক্ষুদ্র নদীটি আমাদের কুটির প্রাঙ্গণের পাশ দিয়ে প্রবাহিত, তার শান্ত, স্তিমিত ধারা, সুখ-দুঃখের দুই- একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ, আমাদের লঘু চপল ফেনোচ্ছাস-এর চিত্রণে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি নিজস্ব সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে তাঁর উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গেছেন।
উপন্যাসে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অবদান
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘নবীন সন্ন্যাসী’ (১৯১২), ‘রত্নদীপ’ (১৯১৭) ও ‘সিন্দুর কৌটা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘নবীন সন্ন্যাসী’ উপন্যাসের নায়ক মোহিত ধর্মপরায়ণ, উচ্চশিক্ষিত, সংসারে বিতৃষ্ণ সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করে এক ভদ্রলোকের গৃহে অবশেষে পীড়িত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। লেখক নায়কের কৃচ্ছতাসাধনকে নিয়ে স্নিগ্ধ বিদ্রুপ-মিশ্রিত কৌতুকরসের সৃষ্টি করেছেন। এই উপন্যাসের কুটচক্রী গদাই পাত্র একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি। ‘রত্নদীপ’ হল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এখানে কাহিনী আকস্মিক দৈবসংঘটনের ওপর নির্ভরশীল হলেও দ্বন্দ্বময় বেদনায় ও আবেগ-গভীরতায় চরিত্র-চিত্রণ সার্থক হয়েছে সন্দেহ নেই। নায়ক রাখালের চরিত্র-সংযম ও গূঢ় প্রণয়াবেগ, বৌরাণীর তীব্র বেদনা ও রাখালের সত্যিকারের পরিচয় আত্মধিক্কারের যন্ত্রণায় পরিস্ফুট চারিত্রিক শুচিতা পাঠকের হৃদয়কে মুগ্ধ করে। কূটচক্রী জুয়াখোর খগেন অভিনেত্রী কনক প্রভৃতির চরিত্রও উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত। ‘সিন্দুর কৌটা’ সাধারণ স্তরের উপন্যাস। এখানে বাঙ্গালী খ্রিস্টান যুবতী সুশীর আগের বিয়ে যেভাবে অসিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে, বিনয়ের প্রথমা পত্নী স্বামীর সঙ্গে সুশীর বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে, বিনয় ও সুশীর মিলনের সমস্ত বাধা অপসারিত হয়েছে, তাতে নিছক গল্পরস ব্যতীত আর কিছু পাওয়া যায় না।
ছোটগল্পে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অবদান
ছোটগল্প রচনাতে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সমধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে আমাদের ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ বাঙালী জীবন ছোটগল্পের পক্ষে অধিকতর উপযোগী। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্পগুলি হল ‘নবকথা’ (১৮৯৯), ‘ষোড়শী’ (১৯০৬), ‘দেশী ও বিলাতী’ (১৯০৯), ‘গল্পবীথি’ (১৯১৬), ‘হতাশ প্রেমিক’ (১৯২৪), ‘পত্রপুষ্প’ (১৯১৭), ‘যুবকের প্রেম’ (১৯২৮), ‘নূতন বউ’ (১৯২৯) এবং ‘জামাতা বাবাজী’ (১৯৩১)। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে উচ্চাঙ্গের কল্পনা, অন্তর্দ্বন্দ্বের জটিলতা বা আবেগের গভীর ঘাত-প্রতিঘাত পাইনা, বাঙালীর জীবনের ছোটখাট সুখ-দুঃখের অসঙ্গতি, পারিবারিক বিরোধের স্নিগ্ধ, সহানুভূতিরস রূপায়ণে বাস্তব জীবনের নিখুঁত চিত্রণে লঘু কৌতুকরসে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি ছোটগল্প সম্বন্ধে আলোচনা করলে তাঁর সহজ সরল জীবনরসরসিকতার বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে। ‘বলবান জামাতা’ গল্পে নামের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসমঞ্জস্য পালোয়ানী চেহারা নিয়ে দীর্ঘকাল পরে জামাই শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলে তাকে চিনতে না পারার দরুন যে বিভ্রাট দেখা দিয়েছে, নির্মল কৌতুকরসে তার মনোরম উপসংহার ঘটেছে। ‘ভুল শিক্ষার বিপদ’ গল্পে ট্রেনের সহযাত্রী যুবকের প্রতি এক বৃদ্ধের অশিষ্ট, উৎকেন্দ্রিক আচরণের মাধ্যমে তার জীবনের এক করুণ অভিজ্ঞতা মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে উদ্ঘাটিত করা হয়েছে। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে নিজের মৃত্যুর পর স্বামীর দ্বিতীয়বার বিয়ে বন্ধ করবার জন্যে রসময়ীর চক্রান্ত বিচিত্র হাস্যরস সৃষ্টি করেছে। আমাদের কুসংস্কারের মৃদু কৌতুকমণ্ডিত ব্যঙ্গ, পরিকল্পনার অভিনবত্বে, প্রথমদিকে অলৌকিকতার রহস্যসৃজনে এই কৌতুক রসোজ্জ্বল গল্পটি সত্যই অভিনব। ‘কাশীবাসিনী’ গল্পে এক পতিতা নারীর করুণ অপত্যস্নেহের কাহিনী গল্পটির মধ্যে এক গভীরতার সুর সঞ্চার করেছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পে উনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগের বাঙালীর জীবনধারা বাস্তবরসোজ্জ্বলতায় ফুটে উঠেছে।