বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬ খ্রীঃ) একটি স্মরণীয় নাম। তিনি ‘বীরবল’ ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। মুখ্যত রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা সাহিত্যে যে গদ্যশৈলী প্রবর্তন করেন এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সমস্ত গদ্য-শিল্পীই ছিলেন যার অনুবর্তী, প্রমথ চৌধুরী (Pramatha Chaudhuri) সর্বপ্রথম সরবে সেই গদ্যরীতির বিরোধিতা ক’রে অপর গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। মধুসূদন দত্ত বাংলা চলিত ভাষাকে ‘মেছুনীদের ভাষা’ নামে বিকৃত করেছিলেন। অতএব এই প্রতিকূল অবস্থায় প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার পক্ষে লেখনী ধারণ করেছিলেন।
প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার পক্ষে বলেন — “যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়।” এবং “তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোন স্থান নেই।” চলিত ভাষা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর এই উক্তিতে যেন স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু তুলনামূলক বিশ্লেষণে বোঝা যায় স্বামী বিবেকানন্দ যখন কথ্য ভঙ্গিতে লিখেছেন তা যেন একেবারে মুখের কথার অনুসরণ। কিন্তু প্রথম চৌধুরীর চলিত ভাষা আদৌ কথ্যরীতির কাছাকাছি আসেনা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য এই যে, তিনি মৌখিক ভাষার সমর্থনে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপিত করলেও তাঁর রচনাকে কোনক্রমেই ‘মৌখিক গদ্যরীতি’ বলা চলে না, তা’ বড় জোর শিষ্ট চলিত ভাষার রীতি বলে গৃহীত হ’তে পারে।
বাংলা সাহিত্যে প্রথম আবির্ভাব কবি-রূপে, তাঁর ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ নামক কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর প্রধান পরিচিতি প্রাবন্ধিক রূপে এবং তাঁর সূচনা ১৯১৪ খ্রীঃ ‘সবুজপত্র‘ নামক সাময়িক পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, এই সাময়িক পত্রিকা সূত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও এর সঙ্গে যুক্ত করেন এবং তাঁকেও চলিত ভাষা-ব্যবহারে প্রবর্তিত করেন। অবশ্য প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং অন্তরঙ্গদের একজন ছিলেন বলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আগেই ছিল। প্রমথ চৌধুরীর অধিকাংশ রচনা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সবুজপত্রে’, পরে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ ছাড়াও অপর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘পদচারণা’। তবে প্রধানতঃ তিনি ছিলেন গদ্যশিল্পী, বিশেষভাবে প্রাবন্ধিক।
প্রমথ চৌধুরীর গদ্যরচনাসমূহ: ‘তেল-নুন-লক্ড়ি’ (১৯০৬), ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৭), ‘নানা কথা’ (১৯১৯), ‘আমাদের শিক্ষা’ (১৯২০), ‘দু-ইয়ার্কি (১৯২১), ‘বীরবলের টিপ্পনী’ (১৯২১), ‘রায়তের কথা’ (১৯২৬), ‘নানা চর্চা’ (১৯৩২), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৩৬), ‘প্রাচীন হিন্দুস্থান’। (১৯৪০) ‘বঙ্গসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়’ (১৯৪৪), ‘আত্মকথা’ (১৯৪৬) এবং ‘প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে হিন্দু মুসলমান’ (১৯৫৩)। তিনি গদ্যশিল্পী হিসাবে অনেকগুলি গল্প রচনা করেছিলেন, নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলিতে সেগুলি সঙ্কলিত হয়েছেঃ ‘চার-ইয়ারি কথা’ (১৯১৬), ‘আহুতি’ (১৯১৯), ‘নীললোহিতের আদি প্রেম’ (১৯৩৪), ‘ঘোষালের ত্রিকথা’ (১৯৩৭), ‘অনুকথা সপ্তক’ (১৯৩৯)।
রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকেও রবীন্দ্র-প্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্বীকারই শুধু করেন নি, প্রমথনাথ চৌধুরী কোন কোন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে যে প্রভাবিতও করেছেন, সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করা হ’য়েছে। কাব্যধারায়ও তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথ থেকে সরে এসে কল্পনা ও আবেগকে উপেক্ষা ক’রে যুক্তিবাদ ও মননশীলতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর সনেটগুলিতে তিনি সনেটের ছন্দ ও যুক্তিকে মেনে চলেও অপর সকল দিকে অনেকখানি স্বাধীনতা নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যুক্তিবাদ ও মননশীলতার সাহায্যে সংস্কারমুক্তির আন্দোলনে যে অগ্রনায়কদের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর কাব্যেও সেই বুদ্ধির দীপ্তি এবং শাণিত ব্যঙ্গ নবযুগের সাহিত্যিকদের মুক্তি সাধনে পথের নির্দেশ দিয়েছিল।
বীরবল: প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ‘বীরবল’ নামের সার্থকতা যথার্থরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে তাঁর অম্লমধুর রসযুক্ত কথাসাহিত্যের বিভিন্ন রচনায়। বীরবল ছিলেন একজন ঐতিহাসিক পুরুষ তিনি আকবর রাজসভার একজন হাস্যরসিক অথচ তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন পরিষদ ছিলেন। তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি তথা wit-এর সঙ্গে লঘুরস তথা humour-এর মিশ্রণ দিয়ে উক্ত ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর গল্পগুলি বিচ্ছিন্ন ও এককভাবে পাঠযোগ্য হ’লেও এদের অনেক কয়টির মধ্যেই কাহিনীগত যোগসূত্রও বর্তমান। কবিতার মতোই কথাসাহিত্যেও প্রমথনাথ রবীন্দ্র-প্রভাবের বাইরে ছিলেন এবং তাঁর অনুপম ‘বীরবলী ঢং’-এর জন্য তাঁর রচনাগুলিতে লঘু হাস্যরসের সঙ্গে চমকপ্রদ বুদ্ধির খেলা যোগ করে এর একটি বিশেষ আস্বাদ্যমনতা সৃষ্টি করেছিলেন। বলা বাহুল্য, যুক্তি-বুদ্ধির প্রাধান্য-হেতু তাঁর রচনা লঘুচিত্ত পাঠকের নিকট খুব উপভোগ্য বিবেচিত হয় নি।
প্রাবন্ধিক: প্রমথ চৌধুরীর প্রধান পরিচয় প্রাবন্ধিকরূপে। তিনি প্রবন্ধ-রচনার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পদক্ষেপে বহুব্যাপ্ত বিচরণভূমি অনায়াসে অতিক্রম করে গেছেন। তিনি বিষয়বস্তু-নির্বাচনে সমকালের যাবতীয় সমস্যাকীর্ণ বিষয়ের উপর দৃষ্টিপাত করেছেন। তিনি ভাষা, সাহিত্য, সমালোচনা, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ইতিহাস প্রভৃতি তাবৎ বিষয়কে অবলম্বন করে বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। তিনি ‘কথার কথা’, ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে সাধুভাষা’, ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’, ‘বাংলা ব্যাকরণ, ‘আমাদের ভাষাসঙ্কট’ প্রভৃতি প্রবন্ধে ভাষা সমস্যার নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। মনোভাব-প্রকাশের পক্ষে যে চলিত ভাষাই স্বাভাবিক এবং সর্বাধিক উপযোগী এইটিই তাঁর বক্তব্যের মূল সুর। তিনি ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘সাহিত্যে চাবুক’, ‘কাব্যে অশ্লীলতা’, ‘বস্তুতন্ত্রতা বস্তু কি’ প্রভৃতি প্রবন্ধে সাহিত্যতত্ত্বের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাহিত্যের উদ্দেশ্য নির্বিশেষে আনন্দদান, কোন ব্যক্তিবিশেষের মনোরঞ্জন নয় এবং সাহিত্য উদ্দেশ্যমূলক নয়—এটিই তাঁর মূল বক্তব্য। প্রমথনাথ চৌধুরী ‘জয়দেব’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘ভারতচন্দ্র’—আদি প্রবন্ধে বিশেষ বিশেষ কবি বা তাঁদের কাব্যকৃতির মূল্য নির্ধারণ করেছেন। তবে এই আলোচনা সূত্রে তাঁর উক্তি — ‘ভাষামার্গে আমি ভারতচন্দ্রের পদানুসরণ করেছি।’— সমর্থনযোগ্য হলেও তিনি যে ভাবে ভারতচন্দ্রের দোষগুলিকে গুণরূপে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অনেকেই সমর্থন করতে পারেন না। এ ছাড়া শিক্ষা, রাজনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে প্রমথনাথ যে সমস্ত প্রবন্ধ রচনা করেন, তাতে তাঁর প্রচুর অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ জাত অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। বস্তুতঃ মনস্বিতার বিচারে একালের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে নানাদিক থেকেই প্রমথনাথের স্থান অবশ্যই প্রথম সারিতেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তকরূপে সর্বাধিক পরিচিত। বস্তুত, তাঁর সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা চলিত ভাষার যে আন্দোলন শুরু করে, অর্ধশতাব্দী মধ্যেই তা’ বাংলা সাহিত্যে একাধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয় এবং বলা বাহুল্য, একালে সাহিত্যে সাধুভাষার ব্যবহার একেবারেই যে লোপ পেয়েছে, তার মূল কৃতিত্বটুকু প্রমথনাথেরই। তবে একথাও সত্য, মুখে বললেও তিনি মৌখিক ভাষাকে বাংলায় চালু করতে পারেন নি; তিনি নিজেও চলিত ভাষায় লেখেননি এবং লেখা সঙ্গতও নয়। সাহিত্যের ভাষা একটু মাজা-ঘষা হবেই এবং তাই শিষ্ট চলিত ভাষাই সাহিত্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রমথনাথের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য যে বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত ‘উইট্’ (wit) এবং বিরোধাভাস বা একজাতীয় ‘প্যারাডক্স’ (paradox), তার বাইরেও তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলার কথা আছে। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “তাঁহার রচনা শুধু সাহিত্যগুণসম্পন্ন নহে, এক অভিনব ভাবপ্রকাশরীতির প্রবর্তক নহে, পরন্ত এক চিরবিস্মিত এবং ফরাসী দেশের দৃষ্টান্ত হইতে নতুন করিয়া শেখা জীবনদর্শনের পুনঃপ্রতিষ্ঠারূপে আমাদের ভাব-জীবনের চিরন্তন সম্পদ।”