ঘটনা, চরিত্র, সংলাপ, বাহির ও ভিতরের দ্বন্দ্ব প্রভৃতির সমবায়ে কোনও জীবনসত্যের সামগ্রিক রূপায়ণ উপন্যাসের লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যঙ্গাত্মক নকশা রচনায় প্রথম উপন্যাসের বীজ অঙ্কুরিত হয়। আর বাংলা উপন্যাসের প্রথম শিল্পী হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—সামাজিক সমস্যার তীক্ষ্ণ উপস্থাপনে, চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দে তাঁর উপন্যাসগুলি আমাদের দেশে সাহিত্যের এই শাখার বিপুল সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে। কিন্তু রোমান্স বা বহিজীবনের ঘটনাশ্রয়ী সংঘাতের প্রাধান্য, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জটিলতার অভাব এবং কঠোর নৈতিক শাসনের মনোভাব বঙ্কিমের উপন্যাসগুলির আধুনিক রুচির একটি গুরুতর ব্যবধান রচনা করেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাতে বাংলা সাহিত্যে যথার্থ আধুনিক উপন্যাসের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্কিম-প্রবর্তিত রোমান্স ও ঘটনাড়ম্বরপূর্ণ ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শ বর্জনে এবং সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাসে ‘এক সূক্ষ্মতর ও ব্যাপকতর বাস্তবতার’ প্রবর্তনে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের এই যুগ পরিবর্তন সূচিত হয়। বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর মত সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাসেও রোমান্সের বাহ্যবৈচিত্র্য, চমকপ্রদ সংঘটনের আকস্মিকতা আমরা লক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গভীর সাহিত্যিক অন্তর্দৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, আমাদের উপন্যাসে ঐ জাতীয় রোমান্সের সার্থকতা নিঃশেষিত হয়েছে, ঘটনাবৈচিত্র্যহীন নিস্তরঙ্গ বাঙালী জীবনে রোমান্সের অসাধারণত্ব আরোপের চেষ্টা তাৎপর্যহীন হবে। সেইজন্য তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধারণ ঘটনার বিস্তৃত বিশ্লেষণে জীবনের মর্মোদঘাটনে, অন্তরের নিভৃতচারী আবেগ-অনুভূতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন ও সংঘাত চিত্রণে উপন্যাসের নতুন শিল্পপ্রকরণের পরীক্ষায়ই ব্রতী হয়েছিলেন।
রোমান্সধর্মী উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম যুগের উপন্যাস অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্স-প্রধান ঐতিহাসিক উপন্যাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ষোল বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘করুণা’ (১৮৭৭-৭৮) নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন, এটি ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও গ্রন্থাকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়নি। তাঁর ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩) ও ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭) রোমান্স-আশ্রিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শেই রচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনা সম্বন্ধে বলেছেন—”প্রাচীর-ঘেরা মন বেরিয়ে পড়ল বাইরে, তখন সংসারের বিচিত্র পথে তার যাতায়াত আরম্ভ হয়েছে। এই সময়টাতে তাঁর লেখনি গদ্যরাজ্যে নতুন ছবি নতুন নতুন অভিজ্ঞতা খুঁজতে চাইল। তারই প্রথম প্রয়াস দেখা দিল ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ গল্পে—একটা রোমান্টিক ভূমিকায় মানবচরিত্র নিয়ে খেলার ব্যাপারে, সেও অল্পবয়সেরই খেলা। চরিত্রগুলির মধ্যে যেটুকু জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে সেটা পুতুলের ধর্ম ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি।” ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে ঘটনাবিন্যাস চরিত্রচিত্রণ অপরিণত ও জটিলতাবর্জিত, প্রতাপাদিত্য, উদয়াদিত্য, বিভা, বসন্ত রায় প্রভৃতি চরিত্রগুলি এক একটি অবিমিশ্র গুণ ও ভাবের প্রতিমূর্তি। আসলে সংসারের নির্মম, কুটিল ক্রুরতায় মানবজীবনের মধুর, কোমল, সুন্দর আবেগ অনুভূতিগুলো নিষ্পেষিত হয় এবং সেই লাঞ্ছনা সত্ত্বেও তাদের সৌন্দর্য ও মহিমাই বিষাদের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এই ভাবকল্পানাকেই তিনি উপন্যাসের কাঠামোয় ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ এবং ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস দুটিতে রূপায়িত করতে চেয়েছেন। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে আমরা দেখি, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি চরিত্র যেন দুটি বিপরীত ভাবের প্রতিমূর্তি-গোবিন্দমাণিক্যের মধ্যে বাস্তব সংগ্রামবিমুখ স্থির আদর্শবাদ আর কালীমন্দিরের পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারান্ধ আচারনিষ্ঠার ক্রুরতা ও দম্ভ অভিব্যক্ত। একমাত্র জয়সিংহের মধ্যেই দুটো বিপরীত ভাবাদর্শের সংঘর্ষজনিত মানসদ্বন্দ্বের সজীবতার কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়।
সমাজসমস্যামূলক উপন্যাসঃ ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৫) রচনার প্রায় সতের বছর পরে কবি ‘চোখের বালি’ (১৯০২) ও ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬) রচনা করেন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঔপন্যাসিক প্রতিভার মৌলিক বিশেষত্ব উন্মোচিত হয়েছে। ‘চোখের বালি’র মহেশ, আশা, বিহারী ও বিনোদিনী এই চারটি চরিত্রের সম্পর্কের মনস্তত্ত্বঘটিত টানাপোড়েন, চরিত্রের গভীরতম উৎস থেকেই প্রবাহিত ঘটনা-পরিবর্তনের নিপুণ বিন্যাসে, সর্বোপরি বাস্তব পারিবারিক জীবনের পটভূমিতে নায়িকা বিনোদিনীর মনস্তত্বের জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ-নৈপুণ্যে এই উপন্যাসটি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বাস্তব জীবন সমস্যা রূপায়ণের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সুচিত করে। ‘নৌকাডুবি’র জীবন চিত্রণে সম্পূর্ণরূপে একই আকস্মিক দৈব-সংঘটন ও বহির্ঘটনার ওপর নির্ভরশীল, চরিত্র-চিত্রণ নিষ্প্রাণ, ঘটনাবিন্যাসের মতো পাত্রপাত্রীদের চরিত্রেও মনস্তত্ত্বের অতিমাত্রায় সরলীকরণ লক্ষণীয়। ‘নৌকাডুবি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্বলতম উপন্যাস। পারিবারিক ঐতিহ্যঘটিত দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস হিসাবে ‘যোগাযোগ’ (১৯২৩) উল্লেখযোগ্য। ধনী ব্যবসায়ী, অর্থ ও ক্ষমতার কুরুচিপূর্ণ অহংকারে উদ্ধত অমার্জিত স্থূল প্রবৃত্তি-সর্বস্ব মধুসুদন ও আভিজাত্যের শালীনতা, সুক্ষ্ম সৌন্দর্যরুচির আবহে লালিত কুমুদিনীর দাম্পত্যজীবনের দ্বন্দ্ববিক্ষোভ এবং কুমুর সন্তান সম্ভাবনায় তার অবসানই এই উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। মধুসুদন-কুমুদিনীর স্বভাবগত পার্থক্য ও তাদের দ্বন্দ্বের চিত্রণ কোন কোন ক্ষেত্রে ভাবগত ও গঠনগত ঐক্যের অভাব, পরিণতির অসংলগ্নতা ও আকস্মিকতা উপন্যাসটির সম্ভাবনাকে খন্ডিত করেছে।
জীবনসমস্যামূলক উপন্যাসঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চার অধ্যায়’ (১৯১৪) প্রভৃতি উপন্যাসগুলি বৃহত্তর জীবনসমস্যামূলক—আমাদের সমাজ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার পটে ব্যক্তিজীবনের সমস্যা তাদের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’য় আমরা দেখি, মহাকাব্যোচিত বিশাল পটভূমিকায় নায়ক গোরার আত্মঅন্বেষণের ব্যাকুলতা ও পরিশেষে যন্ত্রণাদীর্ণ আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে আচারগত ধর্মবিশ্বাসের সংকীর্ণতা জয় করে ভারতীয় জীবন ও সাধনার যথার্থ মানবিক সার্বজনীন আদর্শে নায়ক কীভাবে তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেল, তারই মহিমাদীপ্ত আলেখ্য রচনা করা হয়েছে। ‘গোরা’ বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মহৎ উপন্যাস—”ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে বৃহত্তর রাজনীতি ও ধর্মাদর্শের এক নিবিড় সুসমঞ্জস মিলন, ব্যক্তি-মানসের শাখা-প্রশাখায় সমস্ত সমাজদেহে প্রবাহিত প্রাণধারার এরূপ স্বচ্ছন্দ সঞ্চরণের দৃষ্টান্ত গোরার পর বাংলা উপন্যাসে দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” ‘ঘরে-বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশী আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদের সাময়িক রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রমত্ততায় নয়, দুঃখের স্থির অটল তপস্যায় আত্মশক্তির উদ্বোধনে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি লভ্য, এই ভাবগত সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসটিতে আইডিয়ার প্রাধান্য বিস্তারে প্রধান দুটি চরিত্র নিখিলেশ এবং সন্দীপকে কেবল দুটি বিপরীত ভাবাদর্শের প্রতিমূর্তি বলে মনে হয়, তাদের ভাবগত সংঘর্ষ, তাদের গতিশীল দ্বন্দ্বময় ব্যক্তিত্বের পটভূমির আশ্রয় পায় নি বলে জীবন্ত হতে পারে নি। কেবল বিমলার সজীব, সচল চরিত্রের চিত্রণে এবং কালগত সামঞ্জস্য ও ভাবগত সুসঙ্গতিতে উপন্যাসটি মূল্যবান হয়েছে। উপন্যাস হিসাবে ‘চার অধ্যায়’ আরও অসম্পূর্ণ ও শিথিল তাতে সন্ত্রাসবাদ আন্দোলনের পরিবেশ বাস্তবানুগামী নয়, এলার দ্বন্দ্ব বিমলার মত উজ্জ্বল ও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
রোমান্টিক উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ পর্বের রচনা ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬) এবং ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯) রোমান্টিক, কাব্যধর্মী উপন্যাসের বিচিত্র আঙ্গিকে সমুজ্জ্বল। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত উপন্যাসের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ অভিনব রচনারীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, এই দুটি উপন্যাসে তারই উজ্জ্বল পরিচিতি পাই। ‘চতুরঙ্গে’ শচীশের আত্মোলব্ধির সমস্যা, তার সাথে দামিনীর মনস্তত্ত্বঘটিত সম্পর্কের জটিল ঘাতপ্রতিঘাত শ্রীবিলাসের ব্যক্তিত্বের স্নিগ্ধতা এক বিচিত্র কবিত্বমন্ডিত সাংকেতিকতার ভঙ্গিতে, তীক্ষ্ণ ইঙ্গিতময়তায় উপন্যাসের অভিনব প্রকাশকলায় রূপায়িত হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা অভিনব সৃষ্টি, এখানে প্রচলিত উপন্যাসের আঙ্গিক অনুসৃত হয়নি। সাংসারিকতার ক্ষুদ্র গন্ডী ও প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ মিলনের উর্ধ্বে এক বিচিত্র, বন্ধনাতীত মানসবিস্তারে অসীমতার উপলব্ধিতে যে নর-নারীর প্রেম একটি বৃহত্তর চরিতার্থতা লাভ করতে পারে, ‘শেষের কবিতা’র সেই প্রেমতত্ত্বটিকেই অতুলনীয় কাব্যধর্মী বর্ণনায় বুদ্ধিদীপ্ত, তির্যক সংহত ভাষণভঙ্গির চাতুর্যে কল্পনার বর্ণ বিস্তারে বিমূর্ত করে তোলা হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক কাব্যধর্মী উপন্যাসের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ‘দুই বোন’ (১৯৩৩) ও ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্রকায় উপন্যাস। প্রিয়া এবং জননী এই দুটি রূপগত ভূমিকায় নারী পুরুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। ‘দুই বোন’-এর কাহিনীর মধ্যে এই তত্ত্বটিই রূপায়িত। তাতে চরিত্র বিশ্লেষণের কোনও গভীরতাই পাওয়া যায় না, শুধু ঔপন্যাসিকের তীক্ষ্ণ, অর্থগূঢ় উজ্জ্বল এবং মন্তব্যগুলো, কবিত্ব-সুরভিত বর্ণনাই আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। ‘মালঞ্চ’-এর অসুস্থ রুগ্ন নারীর ক্ষুদ্র ও তাৎপর্যহীন মনোবিকারের চিত্রণেরও কোনও গভীরতা নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে অধিকাংশ বাঙালী ঔপন্যাসিক তাঁর নিকট ঋণী। একদিক থেকে ‘চোখের বালি’ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জটিল প্রক্রিয়ায় অবৈধ প্রেম ও নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চিত্রণে তিনি শরৎচন্দ্রের পথ প্রদর্শন করেছেন, অন্যদিকে তেমনি ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘শেষের কবিতা’র মতো কাব্যধর্মী, সাংকেতিকতার ব্যঞ্জনাপূর্ণ উপন্যাস রচনা করে অতি আধুনিক ঔপন্যাসিকদের নিকট উপন্যাসের নতুন আঙ্গিক পরীক্ষায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।