বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা লক্ষ্য করি, উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজী শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে বাংলা সাহিত্যে যে গদ্যরচনার সূত্রপাত হয়, তার ফলে সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজনের স্থূলতাকে অতিক্রম করে বাংলা প্রবন্ধের মধ্যে সাহিত্যের শিল্পলাবণ্য ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে। প্রবন্ধের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’ প্রকৃষ্ট বন্ধনযুক্ত অথবা যুক্তিশৃঙ্খল-সংবলিত গদ্যরচনাকেই প্রবন্ধ বলা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র-পূর্ববর্তী যুগের অধিকাংশ গদ্য-লেখকদের রচনাই ছিল এইরূপ প্রবন্ধ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের রচনায় সাহিত্যের শ্রী কিছু পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই ছিল বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী। তিনি প্রবন্ধের কায়ায় সর্বপ্রথম সাহিত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) প্রতিভার স্পর্শে প্রকাশভঙ্গির অতুলনীয় ঐশ্বর্যে প্রবন্ধ সাহিত্য তাঁর অন্যান্য সাহিত্যসৃষ্টির মতই বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র পনের বৎসর বয়সে ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় কবি প্রথম প্রাবন্ধিকরূপে আবির্ভূত হন এবং মৃত্যুর পূর্বে ১৯৪১ সালের বৈশাখ মাসে ‘সভ্যতার সংকট’ নামক প্রবন্ধটি রচনা করেন। এই দীর্ঘ প্রায় পঁয়ষট্টি বছর ধরে শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মসংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি মানব সভ্যতার প্রতিটি শাখা সম্বন্ধেই তিনি অজস্র প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য মনন ও কল্পনার গভীরতায়, মর্মসঞ্চারী আবেগে, উপমা ও উপমান ও চিত্রকল্পের সার্থক প্রয়োগে, প্রকাশকলার ঐশ্বর্যে তাঁর প্রবন্ধগুলি সত্যই তুলনাহীন। বিখ্যাত ইংরেজ সমালোচক মিডল্টন মারেকে অনুসরণ করে বলা যায় শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনাশৈলীতে লেখকের ব্যক্তিত্বই প্রাণময় রূপ পরিগ্রহ করে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি প্রবন্ধই তাঁর ব্যক্তিত্বের অনন্যতার স্পর্শে দীপ্ত, তাঁর যে সকল প্রবন্ধ বিষয়ধর্মী, সেখানেও তাঁর শিল্পব্যক্তিত্বই সাহিত্যের লাবণ্য ও শ্রী ফুটিয়ে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধগুলিকে আমরা মোটামুটিভাবে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করে নিতে পারি: সাহিত্য সমালোচনা, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, দর্শন, ভ্রমণ সাহিত্য, পত্রসাহিত্য এবং ব্যক্তিগত আবেগধর্মী রচনা।
(১) সমালোচনা সাহিত্যঃ ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’, ‘অবসর সরোজিনী’ ও ‘দুঃখসঙ্গিনী’ এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের সমালোচনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য রচনার সূত্রপাত হয়, পরবর্তীকালে তিনি সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যপ্রসঙ্গ বিষয়ে বহু আলোচনা করেছেন। কবির দীর্ঘ জীবনব্যাপী সাহিত্যসাধনার পূর্বে সমালোচনা-তত্ত্ব এবং সাহিত্য-বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধগুলি ‘প্রাচীন সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘লোকসাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) এবং ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) প্রভৃতি গ্রন্থগুলি সংকলিত হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্রষ্টারূপ তাঁর সমালোচনা সাহিত্যেও উদ্ভাসিত। বাংলা সাহিত্যে সার্থক সমালোচনার সূত্রপাত প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রই করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিদৃষ্টি ও গভীর রসোপলব্ধির দ্বারা তাঁর দিগন্তটিকে আরও বিস্তৃত করে তাকে এক অভিনব সৌন্দর্যে মণ্ডিত করেন ‘সাহিত্য’, ‘আধুনিক সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে। আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্ব-বিচার স্বকীয় অনুভূতির আলোয় সমুজ্জ্বল। ভারতীয় অধ্যাত্মবিশ্বাসের সত্য, সুন্দর ও শিবের সম্মিলনের আদর্শকেই সাহিত্যের প্রাণবস্তুরূপে গ্রহণ করে তারই আলোকে সাহিত্যকর্মের মূল্য নিরূপণ করেছেন। তাঁর সর্ববিধ সাহিত্যালোচনাতেই একটি সামগ্রিক রসদৃষ্টি উদ্ভাসিত। প্রাচীন, আধুনিক বা লোকসাহিত্য-যে সকল ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর সমালোচনা তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন, তা নিছক শুষ্ক বিচার-বিশ্লেষণে পর্যবসিত না হয়ে নতুন সৃষ্টির ভাস্বরতায় দীপ্ত হয়েছে।
(২) চিন্তামূলক প্রবন্ধঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে রাষ্ট্রনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়েও চিন্তা ভাবনা করেছেন। এই গ্রন্থগুলি তারই স্বর্ণফসল: ‘আত্মশক্তি’ (১৯০৫), ‘ভারতবর্ষ’ (১৯০৬), ‘সঞ্চয়’ (১৯১৬), ‘পরিচয়’ (১৯১৬), ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ (১৯০৭), ‘শিক্ষার ধারা’, ‘কালান্তর’ (১৯৩৭), ‘রাজাপ্রজা’ (১৯০৮), ‘সমূহ’ (১৯০৮), ‘স্বদেশ’ (১৯০৮), ‘সমাজ’ (১৯০৮), ‘ধর্ম’ (১৯০৯), ‘শিক্ষার মিলন’ (১৯২১), ‘মানুষের ধর্ম’ (১৯৩৩) এবং ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯৩৫)। তিনি এই প্রবন্ধগুলিতে মূলনীতি যেমন তেমনি বিশেষ বিশেষ সমস্যাগুলি সম্বন্ধেও গভীর অন্তদৃষ্টিতে আলোচনা করেছেন। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা প্রভৃতি সকল বিষয়েই তিনি উদার ও সর্বজনীন মানবতার আদর্শকেই উজ্জ্বল করে তুলেছেন, প্রবন্ধগুলিতে তাঁর প্রজ্ঞাদৃষ্টি এক নির্মল, শুচি আলোক বিকীর্ণ করেছে। কবির ব্যক্তি-হৃদয়ের নিবিড় উপলব্ধিতে, সত্যের ধ্যানের গাম্ভীর্যে, মননশীলতায় সার্বভৌম মানবধর্মের শুচিতা যেমন তেমনি নিজের দেশ ও সভ্যতা সম্বন্ধে বেদনাময় উৎকণ্ঠায় তাঁর তাত্ত্বিক ও সমস্যামূলক প্রবন্ধগুলি এক অপূর্ব ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়েছে।
(৩) ভ্রমণ সাহিত্যঃ বিশ্বের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও তাদের পরিচয় লাভ ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মোপলব্ধির সাধনারই এক অঙ্গ, তাই ব্যাকুল জীবনাগ্রহ আত্মবিস্তারের আকৃতিতে বার বার তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন। দু-একবার বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হলেও তিনি বিদেশের সভ্যতার প্রাণ সম্পদের অন্তরঙ্গ পরিচয় লাভের চেষ্টা থেকে বিরত হননি। পত্রাকারে বা দিনলিপিকার ধাঁচে লেখা তাঁর ‘যুরোপ প্রবাসীর পত্র’ (১৮৭৫-৮০) ‘যুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’ (১৮৯০-৯৩), ‘জাপান যাত্রী’ (১৯১৯), ‘রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), ‘পারস্যে’ (১৯৩৬) প্রভৃতি গ্রন্থগুলি গতানুগতিক ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, তারা কবির বিশ্বসভ্যতা পরিক্রমার উজ্জ্বল পরিচিতি। কবির ভ্রমণ সাহিত্যের প্রথম দুটি ‘মুরোপ প্রবাসীর পত্র’ এবং ‘যুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’তে তিনি প্রথম চলিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন।
(৪) পত্রসাহিত্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রসাহিত্যও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর বিশিষ্ট দান। পত্রসাহিত্যের আদর্শ হল একটি সহজ, অন্তরঙ্গ সুর, লেখকের পরিবারস্থ ব্যক্তি ও বন্ধুবান্ধবদের নিকট তাঁর মনের এমন একটি স্বচ্ছ প্রতিফলন যা অন্য কোনরূপ সাহিত্যিক ভঙ্গিতে অলভ্য—পত্রসাহিত্যের শিল্পী সমালোচক-নির্দেশিত হৃদয়ের এই অন্তরঙ্গতার আস্বাদ রবীন্দ্রনাথের পত্রগুলিতে যে বিশেষ মেলে না তা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অবশ্য কবির পত্রগুলিতে জীবন সম্বন্ধে যে প্রজ্ঞাদৃষ্টি, গভীর সৌন্দর্য চেতনা, প্রকৃতির কবিত্বময় বর্ণনা, নিজের কাব্যের বিষয়ে আত্মবিশ্লেষণ আলোচনা পাওয়া যায়, তা আমাদের গদ্য সাহিত্যের অতুলনীয় ঐশ্বর্য। তাঁর চিঠিপত্রের সংকলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠগ্রন্থ ছিন্নপত্র’-এর যে পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও নিভৃত মানসের নেপথ্যলোক অনেকটা পরিমাণেই উদ্ঘাটিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টির একটি স্বর্ণ- যুগের পশ্চাৎপটের মানস ইতিহাস ‘ছিন্নপত্র’ -এর কবিহৃদয় আবেগে উষ্ণ, সজীব, চিত্র ও সঙ্গীতের ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ ভাষায় বিবৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য পত্র সংকলনের মধ্যে ‘পথ ও পথের প্রান্তে’ (১৯৩৮), ‘পথের সঞ্চয়’ (১৯৩৯) উল্লেখযোগ্য।
(৫) রস-সাহিত্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত আবেগধর্মী প্রবন্ধগুলির সার্থকতা বিষয়বস্তুর মহিমায় নয়, এক গভীর রসব্যঞ্জনায়ই নিহিত। এই জাতীয় রচনার মধ্যে ‘পঞ্চভূত’ (১৮৯৭), ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ (১৯০৭), ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২), ‘লিপিকা’ (১৯২২) প্রভৃতি। ‘পঞ্চভূত’-এ বা ‘বিচিত্র প্রবন্ধ-এ কোনও নির্দিষ্ট বক্তব্য বা প্রতিপাদ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার পরিবর্তে কবি এক-একটি প্রসঙ্গকে অবলম্বন করে ভাবনা ও কল্পনার বর্ণসুষমায় বিচিত্র সৌন্দর্য রচনা করেছেন। ‘পঞ্চভূত’-এ পাঁচটা কাল্পনিক চরিত্র ও তাদের বৈঠকের সভাপতি স্বয়ং লেখকের কথোপকথনে আলাপচারিতার সূত্রে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় এক অপূর্ব রস-সৌন্দর্য সংশ্লিষ্ট হয়েছে। পঞ্চভূতের ‘মন’, ‘পল্লীগ্রাম’ প্রভৃতি রচনাগুলিতে এই বৈঠকী আলাপের রীতি অবলম্বিত হয়নি, এগুলি ডায়েরী জাতীয় আত্মনিষ্ঠ রচনা। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’-এর রচনাগুলি সম্পূর্ণরূপেই আবেগধর্মী মন্ময়তাপ্রধান রচনা, তাদের মধ্যে ‘কবির একটি বিশেষ ভাবানুভূতি, ধ্যানদৃষ্টির একটি অতর্কিত উৎক্ষেপ, স্বপ্নাতুর কল্পনার একটি বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প অপরূপ কাব্যসৌন্দর্যের মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে।” ‘জীবনস্মৃতি তে কবি তাঁর নিছক ব্যক্তিজীবনের ইতিবৃত্ত রচনা করেননি, নিজের ব্যক্তিরূপের বিকাশের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটা ঘটনা ও দিক স্মৃতিচারণায়, আবেগোপলব্ধির বর্ণনানুরঞ্জনে পাঠকদের নিকট হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন।
গদ্য তাঁর প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যকে কিছুমাত্র না হারিয়ে যে কিভাবে কবিতার ছন্দ ও চিত্রসম্পদ মণ্ডিত হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রবন্ধ সাহিত্যে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। শ্রীঅতুলচন্দ্র গুপ্ত যথার্থই বলেছেন: “রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ মহাকবির হাতের প্রবন্ধ।” প্রাবন্ধিক হিসাবে বাংলা সাহিত্যে তিনি অনন্য, নিঃসঙ্গ একাকী বিরাট জ্যোতিষ্কের মত দেদীপ্যমান”