সুদূর প্রাচীনকালে সংস্কৃত-ল্যাটিন, ইতালীয়, ফরাসী ইত্যাদি ভাষায় ‘টেল’ বা ‘আখ্যান’ রচিত হয়েছে। মানুষের গল্প শোনবার আগ্রহ চিরন্তন। কিন্তু প্রাচীন আখ্যান আর আধুনিক কালের ছোটগল্প স্বরূপধর্মের দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু। উপন্যাসের বিকাশ একটি নির্দিষ্ট পরিণতির স্তরে পৌঁছবার পরেই ছোটগল্পের উদ্ভব হয় এবং এডগার অ্যালান পো, মোপাঁসা, চোখভ, ও হেনরী প্রভৃতি শিল্পীদের চর্চায় এটি আঙ্গিকগত উৎকর্ষ লাভ করে। আয়তনের ক্ষুদ্রতা ছোটগল্পের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। গীতিকবিতার মতো ছোটগল্পের সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত সংঘাতরূপে একটি নির্দিষ্ট, সুনির্বাচিত সীমায় জীবনের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সমস্যা যন্ত্রণার একটিমাত্র দিক, জীবনের খণ্ডাংশই বিদ্যুতের মত মুহূর্তে জীবন্ত দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদের মতই জীবনের একাংশের চকিত স্ফুরণেই মানবজীবনের অপরিমেয়তা আভাসিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বর্ষাযাপন’ কাব্যপঙক্তিগুলোতে ছোটগল্পের প্রাণধর্ম আশ্চর্য সুন্দরভাবে দ্যোতিত হয়েছেঃ
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল;
সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ;
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
পটভূমিঃ আমাদের বৈচিত্র্যহীন ঘটনাসংঘাতবর্জিত, শান্ত, নিস্তরঙ্গ, জীবন ছোটগল্প রচনার বিশেষ উপযোগী, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প রচনার কোনও সার্থক প্রয়াস আমরা পাই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের শিল্পকলার সূত্রপাত করেন এবং তিনি অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ১২৯১ সালের ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ঘাটের কথা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ছোটগল্প এবং তাতেই বাংলা সাহিত্যে এই শিল্পমাধ্যমটির আবির্ভাব সূচিত হয়। এরপর কবি ‘হিতবাদী’ (১৮৯১) সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছোটগল্প রচনা করেছেন। জমিদারি তত্ত্বাবধানের সূত্রে পল্লী-জীবনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবজীবনের সুখ-দুঃখের বিচিত্র ও বহুমুখী ধারায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, কবির শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলো তারই স্বর্ণফসল। পল্লীজীবনের যে অভিজ্ঞতা তাঁর ছোটগল্প সৃষ্টিপ্রেরণাকে উদ্বোধিত ও তার মূলে প্রাণরস সিঞ্চিত করেছে, সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন— “বাংলাদেশের নদীতে নদীতে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি; এর নূতনত্ব চলন্ত বৈচিত্র্যের নূতনত্ব। শুধু তাই নয়, পরিচয়ে-অপরিচয়ে মেলা মেশা করছিল মনের মধ্যে। ক্ষণে ক্ষণে যতটুকু গোচরে এসেছিল তার চেয়ে অনেকখানি প্রবেশ করেছিল মনের অন্দর মহলে আপন বিচিত্র রূপ নিয়ে। সেই নিরন্তর জানাশোনার অভ্যর্থনা পাচ্ছিলুম অন্তঃকরণে, উদ্বোধন এসেছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাবে ছোটগল্পের নিরন্তর ধারায়।”
সাধারণ সুখ-দুঃখের কাহিনী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের অফুরন্ত বিষয়-বৈচিত্র্য সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কিছুসংখ্যক গল্পে সাধারণ সুখদুঃখের ধারায় পল্লীর জীবনযাত্রা ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আবেগস্বচ্ছলতা চিত্রিত হয়েছে,’ ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’, ‘শাস্তি’, ‘দিদি’, ‘রাসমণির ছেলে’, ‘পণরক্ষা’, ‘দান-প্রতিদান’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ প্রভৃতি এই জাতীয় গল্প। ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘ঠাকুরদা’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘স্বর্ণমৃগ’ প্রভৃতি গল্পে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক প্রচলিত ধারায় ব্যতিক্রম ঘটলে যে বিপর্যয় ও বিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্ট হয়, তারই আলেখ্য পাই। কতকগুলো গল্পে কারুণ্য ও শ্লেষের তীক্ষ্ণতায় প্রকাশিত—‘দেনাপাওনা, যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ, হৈমন্তী, স্ত্রীর পত্র, পয়লা নম্বর, ‘পাত্র ও পাত্রী’ ইত্যাদি।
প্রেমের গল্প: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের গল্পগুলো বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় সম্পদ। প্রেমের বিভিন্ন নিগূঢ় আবেগ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘাতপ্রতিঘাত, তার বিচিত্র ও রহস্যময় বিকাশ, প্রতিহত প্রেমের গভীর বিপদ, প্রেমের মধ্যে দিয়ে মানবাত্মার আকুতির ব্যঞ্জনা, প্রেমের সংকীর্ণ, জটিল, স্বার্থপরতার দিক এ-সমস্তই তাঁর ‘একরাত্রি’, মহামায়া, সমাপ্তি, দৃষ্টিদান, মাল্যদান, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, মানভঞ্জন, দুরাশা, অধ্যাপক, শেষের রাত্রি’ প্রভৃতি গল্পগুলোতে আশ্চর্য কাব্যব্যঞ্জনায় প্রাকৃতিক পরিবেশের অর্থগুঢ় চিত্রণে, ইঙ্গিতময়তার রূপায়িত হয়েছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্কঃ ‘শুভা, অতিথি, আপদ’ প্রভৃতি গল্পে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় আত্মীয়তার সম্বন্ধ চিত্রিত হয়েছে। “নিতান্ত অনায়াসে, সামান্য দুই একটি রেখাপাতের দ্বারা তিনি মানবমনের সহিত বহিঃপ্রকৃতির অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সিংহদ্বারটি খুলিয়া দিয়াছেন—তাঁহার তুচ্ছ গ্রাম্য কাহিনীগুলিও প্রকৃতির সূর্য-চন্দ্র-খচিত চন্দ্রাতপের তলে, তাহার আভাস-ইঙ্গিত-আহ্বান-বিজড়িত রহস্যময় আকাশ-বাতাসের মধ্যে এক অপরূপ গৌরবে মন্ডিত হইয়া উঠিয়াছে।” বিশেষত তাঁর অবিস্মরণীয় গল্প ‘অতিথি’তে প্রকৃতির প্রাণলীলা মানবজীবনে ছন্দায়িত হওয়ার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তাঁর তুলনা মেলা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রাকৃত রসাশ্রিত ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে, মণিহারা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবি এই সকল রচনায় নিপুণ কৌশলে ব্যঞ্জনাময় বর্ণনায়, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে, কল্পনার বিচিত্র বর্ণবিলাসে বাস্তব জীবনের সঙ্গে অতি-প্রাকৃতের বিচিত্র সমন্বয় সাধন করেছেন। সমস্যার উপস্থাপনায় কোথাও বিশ্লেষণ নৈপুণ্য ও বাগভঙ্গির শাণিত দীপ্তি বিস্ময়কর হলেও সেখানে সজীব প্রাণের কোনও স্পর্শ পাওয়া যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রসনিটোল ছোটগল্পগুলো বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য। তিনিই বাংলা সাহিত্যে এই শিল্পকলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ভিত্তি নির্মাণ করে যান, পরবর্তী কালের ছোটগল্প লেখকেরা তাঁর পদচিহ্নিত পথই অনুসরণ করেছন।