বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা উপন্যাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। তিনি সমসাময়িক যুগের ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকে দূরে ছিলেন। যে অসাধারণ কবিকল্পনার বর্ণনানুরঞ্জনে গভীর প্রজ্ঞাদৃষ্টিতত্ত্ব ও ভাবপ্রেরণার প্রকাশভঙ্গির ক্ষুরধার নৈপুণ্যে তাঁর উপন্যাসগুলি ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁর অনুসরণ কখনো যথার্থভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে নি। ঔপন্যাসিকেরা সেইসময় নিতান্ত সাধারণ শ্রেণীর উপন্যাস রচনা করে পাঠকদের কাহিনী রসতৃষ্ণা নিবারণ করছিলেন। একদিকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে ভাবকল্পনার বিচিত্র ও নতুন অভিব্যক্তি সম্বন্ধে দূরত্ববোধ, অন্যদিকে উপন্যাস সাহিত্যে গতানুগতিক রুচির অনুবর্তনে ঔপন্যাসিকদের আত্মতুষ্টি—এই অচলাবস্থার মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব বাংলা উপন্যাসে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত করে।
মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঔপন্যাসিক প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। তিনি তাঁর পূর্বসুরীর বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও ভাষাভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেন নি, কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিটি রচনা তাঁর শিল্প-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক যুগে একমাত্র শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশকলার স্বকীয়তা বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ ও নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করেছে, এটাই তাঁর বিস্ময়কর কৃতিত্বের নিদর্শন। এই শিল্পীর মৌলিকতা সত্যই অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনার বিস্তার ও ভাবব্যঞ্জনার সৌন্দর্য শরৎচন্দ্রের রচনায় নাই, কিন্তু বাস্তব অনুভূতির তীব্রতায় বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষতার সহজ সরল মানবিকতায় শিল্পীর সহানুভূতির উষ্ণ স্পর্শে তাঁর উপন্যাস আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
বাস্তবধর্মিতা: পারিবারিক জীবনের পটভূমিতে স্নেহপ্রেমের জটিলতা ও বঙ্কিম গতির চিত্র রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনায় পাওয়া যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘কাশীনাথ’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বড়দিদি’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘স্বামী’ প্রভৃতি গ্রন্থে বাঙালী পরিবারের ক্ষুদ্র বিরোধ ও সংঘাতের চিত্র অঙ্কিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের পথপ্রদর্শক, কিন্তু শরৎচন্দ্রের চিত্রণ-পদ্ধতি তাঁর পূর্বসূরী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ এই বিরোধের ওপর শেষ পর্যন্ত একটি কাব্যসৌন্দর্য বিস্তার করেন, মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সঙ্গে কল্পনা-সমৃদ্ধি, একটি ভাবাদর্শের ব্যঞ্জনা কাহিনীর পরিচিত জগতের ওপর এক বিচিত্র সৌন্দর্য ও কল্পনার মায়াজাল ছড়িয়ে দেয় — “শরৎচন্দ্রের গল্পে বাস্তবতার সুরটি আরও তীক্ষ্ণ ও অসন্দিগ্ধভাবে আত্মপ্রকাশ করে, কবিত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের অন্তরালে চাপা পড়ে না। ভাবপ্রকাশের গভীরতাতেও তাঁহারই শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁহার গল্পগুলিতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র সংঘাতগুলি অন্তর্বিপ্লবের বিদ্যুৎচমকে দীপ্ত হইয়া উঠে।”
নারীচরিত্র: নারী-চরিত্র অঙ্কনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শক্তির বৈশিষ্ট্য তথা তার মৌলিকতা লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের নারীচরিত্রগুলির রূপায়ণে নারীর ব্যক্তিত্ব স্ফুরণের প্রয়াস লক্ষিত হলেও তা ভাবাদর্শের দ্বারা অনুরঞ্জিত। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নারীর ব্যক্তিত্ব স্ফুরণ আরও উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ — “এমনকি তাঁহার প্রথম যুগের উপন্যাসগুলিতেও, যেখানে সমাজ বিদ্রোহের সুর সেরূপ তীব্র নয় ও পারিবারিক কর্তব্য পালনই স্ত্রীলোকের প্রধান কার্য, সেখানেও তাহার দৈনিক সমাজনির্দিষ্ট কার্যগণ্ডির অভ্যন্তরেও তাহাদের মধ্যে একটি নতুন সতেজ প্রকাশভঙ্গী, একটি দৃপ্ত মহিমান্বিত তেজস্বিতার পরিচয় পাওয়া যায়।” রবীন্দ্রনাথের প্রেম চিত্রণের কাব্য-সৌন্দর্য ও ভাবাদর্শের ব্যঞ্জনা শরৎচন্দ্রের রচনায় নেই, কিন্তু প্রেমের রহস্য উন্মোচন ও স্বরূপ নির্ণয়ে, তার তীব্র আবেগের চিত্রণে শরৎচন্দ্র যে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার অসাধারণত্ব আমাদের স্বীকার করতেই হয়।
সমাজ সমস্যা: সমাজ সমস্যার আলোচনামূলক উপন্যাসেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব পরিস্ফুট। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উপন্যাসেই আমরা বাঙালী সমাজের মজ্জাগত সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার প্রবণতার সমালোচনা পাই। কিন্তু “রবীন্দ্রনাথ সাধারণতঃ এই বিষয়ের খুব ব্যাপক ও গভীর বিশ্লেষণ করেন না, প্রসঙ্গক্রমে সামাজিক দুর্নীতিগুলির প্রতি কটাক্ষপাত বা অঙ্গুলি সংকেত করেন, ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যালোচনাই তাঁহার প্রধান বিষয়।” আর শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’, ‘বামুনের মেয়ে’ ও ‘পল্লীসমাজে’ আচারসর্বস্ব কুসংস্কারের সমাজশক্তি আনুষঙ্গিক উৎপীড়ন বা আবেগতীব্রতা ও বাস্তবচিত্রণের তীক্ষ্ণতায় উদ্ঘাটিত হয়েছে, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তার কোনও তুলনা মেলে না। এই প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেনঃ “অন্যান্য লেখকের সহিত তুলনায় শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে এই অত্যাচার কাহিনী আরও করুণরস প্রধান ও মর্মস্পর্শী হইয়াছে। তাঁহার বিশ্লেষণ যেমন তীক্ষ্ণ ও অভ্রান্ত-লক্ষ্য, তাঁহার করুণরস সঞ্চার করিবার ক্ষমতাও সেই পরিমাণে অসাধারণ।”
নিষিদ্ধ প্রেম: ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি উপন্যাসে নিষিদ্ধ সমাজবিরোধী প্রেমচিত্রণে শরৎচন্দ্রের অনন্যসাধারণ দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের নায়িকা বিনোদিনীর প্রেমের সমস্যা শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শবাদে লীন হয়, তাকে উচ্চ ভাবলোকে উত্তীর্ণ হতে দেখি। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে সমাজ-শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও নিজেরও আবেগ সংস্কারের আন্তরসংঘাতে নারীর আত্মোপলব্ধির সমস্যা আরও বাস্তব, জটিল এবং তীক্ষ্ণ। বিশেষতঃ ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের নায়িকা অচলার ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার টানাপোড়েনে নারীর দোলাচলবৃত্তির সমস্যা যে বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য ও সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিতে চিত্রিত হয়েছে, তা অতুলনীয়। আর কোনও ঔপন্যাসিকই যন্ত্রণার অগ্নিদহনে দগ্ধ নারীর হৃদয়কে এমন রক্তবর্ণে, বাস্তব অভিজ্ঞতার তীব্রতা ও প্রত্যক্ষতায় উজ্জ্বল করে তুলতে পারেন নি।