বিদেশী পর্যটকরা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রশংসা করেছেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্য হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিজয়নগর রাজ্যের খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত সাহিত্য পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং তামিল, তেলেগু, কন্নড় প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষাগুলি যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করে। বৈদিক গন্থের বিখ্যাত টীকাকার মাধবাচার্য ও সায়নাচার্য বিজয়নগর রাজ্যের রাজানুকল্য অর্জন করেন। দ্বিতীয় দেবরায় সাহিত্য-সংস্কৃতির পষ্ঠপোষক ছিলেন। বিখ্যাত কন্নড় কবি কুমারব্যাস ও তেলেগু কবি শ্রীনাথ তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন পণ্ডিত ও সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী। কবি ও সুসাহিত্যিক কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতীয় সাহিত্যের নবযুগ হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর রাজসভায় বহু পণ্ডিতের সমাবেশ ঘটে এবং তিনি নানাভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কথিত আছে যে, তাঁর রাজসভা ‘অষ্ট-দিগগজ’ নামে আটজন সুধী ব্যক্তি দ্বারা অলংকৃত ছিল। বিখ্যাত তেলেগু কবি পেড্ডান রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সভাকবি ছিলেন। তাঁকে ‘অন্ধ কবিতার পিতামহ’ (তেলগু কাব্যের পিতামহ) বলা হয়। কৃষ্ণদেব রায় নিজে সংস্কত ভাষায় পাঁচটি এবং তেলেগু ভাষায় ‘আমুক্ত মাল্যদা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আরবিডু বংশের রাজারাও সাহিত্য, শিক্ষা ও তেলেগু ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এদের আগ্রহে সংগীত, নৃত্য, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয় এবং নাট্যশালার বিকাশ ঘটে। কৃষ্ণদের রায় ও রাম রায় সংগীতজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। বিজয়নগরের রাজারা স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরা বহু সুদৃশ্য ও সুরম্য প্রাসাদ, মন্দির ও হর্মাদি নির্মাণ করেন। বিজয়নগরের শিল্পরীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র ছিল। বিজয়নগরের শাসকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের আক্রমণের পরে অবশিষ্ট যে হিন্দু শিল্প-স্থাপত্য টিকে আছে তাকে রক্ষা করা এবং ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সৌধ, মন্দির ইত্যাদিকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। পুরানো মন্দিরগুলিকে সংযোজিত হলঘর, মণ্ডপ ইত্যাদি দ্বারা অধিকতর প্রশস্ত ও সুন্দর করে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়। মন্দিরের বাম দিকে গড়ে তোলা হয় ‘কল্যাণমণ্ডপ’। অসংখ্য থামবিশিষ্ট ছাদের নিচে ঠিক মাঝখানে রাখা হয় একটি মঞ্চ। থাম বা স্তম্ভগুলির বিচিত্র ও জটিল অলংকরণ ছিল বিজয়নগর শিল্পরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাজা কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন এক মহান নির্মাতা। কৃষ্ণদেব রায়ের নির্মিত ‘হাজারা মন্দির’ হিন্দু স্থাপত্যের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ‘ভিটলস্বামী মন্দির’-এর কারুকার্য আজও মানুষের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কলা-সমালোচক ফার্গুসন-এর মতে, ভিটলস্বামী মন্দিরটি দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির এক অপূর্ব নিদর্শন। পর্তুগীজ পর্যটক পায়েজ-এর মতে, বিজয়নগরের রাজপ্রাসাদটি লিসবনের রাজপ্রাসাদের চেয়েও বড়ো। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও বিজয়নগর রাজ্য যথেষ্ট উন্নত ছিল। তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণতীরের প্রায় সর্বত্র বিজয়নগর শিল্পরীতির নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। পর্যটকেরা বিজয়নগর শহর ও রাজপ্রাসাদের নির্মাণ-শৈলীর প্রশংসা করেছেন। রাজপ্রাসাদটি ছিল অতি-সুরক্ষিত দুর্গবিশেষ।