আকবর উত্তর ভারতে আধিপত্য স্থাপন করার পর দাক্ষিণাত্য রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেন। মালব, গুজরাট ও উড়িষ্যা প্রভৃতি রাজ্যগুলির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। আকবর গুজরাট ও মালব অধিকার করার পর দাক্ষিণাত্যের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করেন। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি জয় করে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্নকে তিনি বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি
১. দক্ষিণ ভারতে পর্তুগিজদের অনুপ্রবেশ আকবরকে চিন্তিত করে তোলে। গুজরাট অভিযানের সময় তিনি সর্বপ্রথম পর্তুগিজদের সংস্পর্শে আসেন। তিনি পর্তুগিজদের নৌশক্তি দেখে বিস্মিত হন। পর্তুগিজরা আরব সমুদ্রে ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলি লুঠ করত এবং হজ যাত্রীদের আক্রমণ করত। পর্তুগিজরা ছিল ধর্মান্ধ। তারা ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের জোর করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা বিজাপুরের সুলতানকে পরাস্ত করে গোয়া দখল করে এবং বহু নর-নারীকে হত্যা করে। এজন্য আকবর দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করে পর্তুগিজদের বহিষ্কারের চেষ্টা করেন।
২. দাক্ষিণাত্য বাহমনী রাজ্য ভেঙে চারটি সুলতানি রাজ্য গড়ে ওঠে; যথা—আহম্মদনগর, বিজাপুর, খান্দেশ ও গোলকুন্ডা। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতানি রাজ্যগুলি জোট বেঁধে বিজয়নগর রাজ্যকে তালিকোটার যুদ্ধে পরাজিত করে। সেই সময় আকবর রাজপুতানা জয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তালিকোটার যুদ্ধের পর সুলতানি রাজ্যগুলি অরাজকতা এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মাহাদিপন্থী ও শিয়াপন্থী ধর্মোন্মত্ততার ফলে বহু লোক নিহত হয়। বিজাপুর, আহম্মদনগর প্রভৃতি রাজ্যগুলি শিয়াপন্থীদের কুশাসনের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। ড. আর. এস. ত্রিপাঠীর মতে, “রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মত্ততার কুৎসিৎ বিকার এবং বিধর্মীদের নিগ্রহ মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে ঘটতে থাকায় আকবরের পক্ষে নীরবে সহ্য করা কঠিন ছিল।”
৩. দাক্ষিণাত্যের সুলতানি রাজ্যগুলি আকবরের মিত্রতা অস্বীকার করেন। সুতরাং আকবর দক্ষিণে সামরিক অভিযানের সঙ্কল্প নেন। তিনি যুবরাজ মুরাদ ও বৈরাম খানের পুত্র আবদুর রহিম খান-ই-খানানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী আহম্মদনগরের বিরুদ্ধে পাঠান। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনী আহম্মদনগর দুর্গ অবরোধ করে। আহম্মদনগরের নাবালক সুলতানের অভিভাবক চাঁদ সুলতানা বিপুল বিক্রমে দুর্গ রক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। বাহাদুর শাহকে আহম্মদনগরের সুলতান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চাঁদবিবি ও বাহাদুর শাহ মুঘলদের প্রতি বশ্যতা জানান এবং বেরার প্রদেশ মুঘলদের ছেড়ে দেন।
আহম্মদনগরের এক শ্রেণির অভিজাত চাঁদ সুলতানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, বেরার প্রদেশ পুনরায় অধিকারের চেষ্টা করলে, যুবরাজ দানিয়েলের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী দৌলতাবাদ অধিকার করার পর, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগর অধিকার করে। চাঁদ সুলতানা আত্মহত্যা করেন। আহম্মদনগরের সুলতান বাহাদুর নিজাম শাহকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করা হয়। আহম্মদনগরের অভিজাতরা শেষ পর্যন্ত মুঘলদের বশ্যতা মেনে নেন।
৪. ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে খান্দেশের সুলতান রাজা আলি খাঁ আকবরের আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে মুঘলদের প্রতি বশ্যতা জানান। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা আলি খাঁর পুত্র মীরণ বাহাদুর শাহ পিতার সিংহাসনে বসে মুঘলদের প্রতি বশ্যতা তুলে নেন। ফলে আকবর নিজে খান্দেশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বুরহানপুর অধিকার করেন। এরপর তিনি দক্ষিণের আসিরগড় দুর্গ অবরোধ করেন। আসিরগড় ছিল আকবরের জীবনের শেষ রাজ্যজয়।
দক্ষিণের দুই সুলতানি রাজ্য বিজাপুর ও গোলকুন্ডা আকবর জয় করার চেষ্টা করেন নি। দক্ষিণে তিনি কোন ধর্মীয় উন্মত্ততা নিয়ে শিয়া রাজ্যগুলি আক্রমণ করেন নি। তাঁর দক্ষিণী বিজয় ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনের ফল। আকবরের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের অভিলাষ এবং পর্তুগিজ শক্তির উচ্ছেদ ছিল তাঁর দক্ষিণী অভিযানের প্রধান কারণ। তিনি দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে নিয়ে আহম্মদনগর, বেরার ও খান্দেশ—এই তিনটি সুবা গঠন করেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানের ফলে তাঁর সাম্রাজ্য কৃষ্মা নদীর উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সমগ্র ভারতবর্ষে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির মধ্যে বিবাদ দূর করা ও সমগ্র ভারতে একই প্রকার আইন ও শাসন স্থাপনের আগ্রহ ছিল তাঁর দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফল।