প্রত্যেকটি যুক্তিতে যুক্তিবাক্যের সমর্থনে সিদ্ধান্ত গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত গঠনের পিছনে আমাদের দুটি উদ্দেশ্য থাকে—কোনো কিছু প্রমাণ করা এবং কোনো কিছু আবিষ্কার করা, অর্থাৎ সত্য হতে পারে—এমন ইঙ্গিত করা। প্রমাণের উদ্দেশ্য নিয়ে যে-ভাবে যুক্তিগঠন করা হয়, তাকে অবরোহ যুক্তি বলে এবং আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে যে-ভাবে যুক্তিগঠন করা হয়, তাকে আরোহ যুক্তি বলে। কাজেই যুক্তি হল দুরকমের—অবরোহ যুক্তি এবং আরোহ যুক্তি।
অবরোহ যুক্তি (Deductive Argument)
যে যুক্তিতে সিধান্ত এক বা একাধিক যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়, অর্থাৎ, যুক্তিবাক্যের সত্যতা থেকে সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হয় এবং যে-যুক্তিতে সিদ্ধান্ত কখনও যুক্তিবাক্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক হয় না, অর্থাৎ, যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না, তাকে অবরোহ যুক্তি বলে।
উদাহরণ:
(১) কোনো কোনো বাঙালি হয় ব্যবসায়ী (যুক্তিবাক্য)।
কোনো কোনো ব্যবসায়ী হয় বাঙালি (সিদ্ধান্ত)।
(২) সকল কবি হয় দার্শনিক (যুক্তিবাক্য)। রাম হয় কবি (যুক্তিবাক্য)।
রাম হয় দার্শনিক (সিদ্ধান্ত)।
অবরোহ যুক্তিকে আমরা সাধারণত তিন বাক্যের যুক্তি (দুটি যুক্তিবাক্য + সিদ্ধান্ত) হিসাবে ব্যবহার করতেই বেশি অভ্যস্ত। তাই এই জাতীয় একটি পরিচিত উদাহরণের সাহায্যে অবরোহ যুক্তি সম্বন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে।
উদাহরণ:
সকল মানুষ হল মরণশীল জীব (যুক্তিবাক্য)।
রাম হয় মানুষ (যুক্তিবাক্য)।
রাম হয় মরণশীল জীব (সিদ্ধান্ত)।
এখানে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত হয়েছে। অর্থাৎ, ‘মানুষ জাতি’-র মরণশীলতার মধ্যেই রামের মরণশীলতা লুকিয়ে রয়েছে। এখানে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়েছে। অর্থাৎ, ‘মানুষ-জাতি’-র সবাই যদি মরণশীল হয় এবং রাম যদি মানুষ জাতিরই একজন হয়, তা হলে রাম অনিবার্যভাবেই মরণশীল হবে। এখানে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হওয়ায় যুক্তিবাক্যের সত্যতা থেকে সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ, দুটি যুক্তিবাক্যের সত্যতার ভিত্তিতে ‘রাম হয় মরণশীল জীব’-এই সিদ্ধান্তটিকে সত্য বলে দাবি করা হয়েছে।
অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যের মধ্যে নিহিত থাকে। তাই এখানে সিদ্ধান্ত—
(i) যুক্তিবাক্যের থেকে কম ব্যাপক হতে পারে।
উদাহরণ:
সকল মানুষ হল মরণশীল জীব (যুক্তিবাক্য)।
সকল মানুষ হয় বুদ্ধিমান জীব (যুক্তিবাক্য)।
কোনো কোনো বুদ্ধিমান জীব হয় মরণশীল জীব (সিদ্ধান্ত)।
এখানে যুক্তিবাক্যে ‘সকল’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে এবং সিদ্ধান্তে ‘কয়েকজন’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত এখানে যুক্তিবাক্যের চেয়ে কম ব্যাপক।
(ii) যুক্তিবাক্যের সমান ব্যাপক হতে পারে।
উদাহরণ:
সকল মানুষ হয় মরণশীল জীব (যুক্তিবাক্য)।
সকল কবি হয় মানুষ (যুক্তিবাক্য)।
সকল কবি হয় মরণশীল জীব (সিদ্ধান্ত)।
এখানে যুক্তিবাক্যে ‘সকল’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে এবং সিন্ধান্তেও ‘সকল’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, যুক্তিবাক্য ও সিদ্ধান্ত এখানে সমান ব্যাপক।
(iii) অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত কখনও যুক্তিবাক্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক হতে পারে না। অর্থাৎ, অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত কখনও যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। এ কথার অর্থ হল যুক্তিবাক্যে নেই এমন কিছু সিদ্ধান্তে বলা যেতে পারে না।
উদাহরণ:
সকল মানুষ মরণশীল এবং রাম মানুষ—এই দুটি যুক্তিবাক্য থেকে রামকে মরণশীলই বলতে হবে। মরণশীল ছাড়া পরিশ্রমী, স্বার্থপর ইত্যাদি রাম সম্পর্কে বলা যাবে না। কারণ, এগুলি যুক্তিবাক্যে নেই।
অবরোহ যুক্তির মাধ্যমে আকারগত বৈধতা প্রমাণ করা হয়।
উদাহরণ:
সকল ধূমবান বস্তু হয় অগ্নিমান বস্তু (যুক্তিবাক্য)।
ওই পর্বতটি হয় ধূমবান বস্তু (যুক্তিবাক্য)।
ওই পর্বতটি হয় অগ্নিমান বস্তু (সিদ্ধান্ত)।
এখানে ধূম ও অগ্নির সম্বন্ধ সম্পর্কে স্বীকৃত সত্যকে বিশেষ একটি ক্ষেত্রে প্রমাণ করা হয়েছে।
অবরোহ যুক্তির বৈশিষ্ট্য
(১) সিদ্ধান্ত এক বা একাধিক যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয় এবং অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়।
(২) সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে বলেই যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হতে পারে।
(৩) সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে বলে যুক্তিবাক্য থেকে কখনও বেশি ব্যাপক হতে পারে না, বা যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না।
(৪) সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে এবং যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় বলে যুক্তিবাক্য সত্য হলেই সিদ্ধান্ত সত্য হয়।
(৫) যুক্তি-গঠনের উদ্দেশ্য হল সিদ্ধান্তের আকারগত বৈধতা প্রমাণ করা।
আরোহ যুক্তি (Inductive Argument)
যে-যুক্তিতে সিদ্ধান্ত সর্বদাই একাধিক যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয়, কিন্তু অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না, অর্থাৎ যুক্তিবাক্যের সত্যতা থেকে সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হয় না এবং যে-যুক্তিতে সিদ্ধান্ত সর্বদাই যুক্তিবাক্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক হয়, অর্থাৎ যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যায়, তাকে আরোহ যুক্তি বলে।
উদাহরণ:
১নং মানুষ মরণশীল (যুক্তিবাক্য)।
২নং মানুষ মরণশীল (যুক্তিবাক্য)।
৩নং মানুষ মরণশীল (যুক্তিবাক্য)।
↓
সকল মানুষ মরণশীল (সিদ্ধান্ত)।
আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তিবাক্যের সমর্থন থাকে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকেই নিঃসৃত হয়, কিন্তু অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না। তাই এখানে ‘যুক্তিবাক্য সত্য, কাজেই সিন্ধান্ত সত্য হবে’—এমন দাবি করা যায় না; কারণ হলো সিদ্ধান্ত এখানে যুক্তিবাক্যের মধ্যে নিহিত থাকে না। অর্থাৎ, সিধান্তে উল্লেখ-করা ‘সকল মানুষ’-কে যুক্তিবাক্যে উল্লেখ করা ‘কয়েকটি মানুষ’-এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সিদ্ধান্ত সর্বদাই যুক্তিবাক্যের চেয়ে ব্যাপক হয়। অর্থাৎ, যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যায়। এইজন্যই যুক্তিবাক্যে নেই—এমন দৃষ্টান্ত সিন্ধান্তে এসে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং সত্যই যদি তা এসে যায়, তাহলে যুক্তিবাক্য সত্য হলেও সিদ্ধান্ত মিথ্যা হয়ে যেতে পারে।
আরোহ যুক্তির বৈশিষ্ট্য
(১) সিধান্ত সর্বদাই একাধিক যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয়।
(২) সিধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে না বলে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না।
(৩) সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে না বলে সিদ্ধান্ত সর্বদাই যুক্তিবাক্যের চেয়ে ব্যাপক হয় বা যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যায়।
(৪) সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যায় বলে যুক্তিবাক্যের সত্যতা থেকে সিধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হয় না। অর্থাৎ, সিধান্তের সত্যতায় সংশয় থেকে যায়।
(৫) যুক্তি-গঠনের উদ্দেশ্য হল সিদ্ধান্তের সত্যতার সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করা। এই ইঙ্গিত সত্য-আবিষ্কারে সাহায্য করতে পারে।
অবরোহ যুক্তি ও আরোহ যুক্তির পার্থক্য
(১) অবরোহ যুক্তিতে এক বা একাধিক যুক্তিবাক্যের সমর্থনে সিদ্ধান্ত গঠন করা হয়। আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্তের পিছনে সর্বদাই একাধিক যুক্তিবাক্য থাকে।
(২) অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে। তাই এখানে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যে নিহিত থাকে না। তাই এখানে সিধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্য ভাবে নিঃসৃত হয় না।
(৩) অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত কখনও যুক্তিবাক্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক হতে পারে না। অর্থাৎ, সিদ্ধান্তের ব্যাপকতা কখনও যুক্তিবাক্যের ব্যাপকতাকে অতিক্রম করে যায় না। আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত সর্বদাই যুক্তিবাক্যের চেয়ে ব্যাপক হয়। অর্থাৎ, সিদ্ধান্তের ব্যাপকতা সর্বদাই যুক্তিবাক্যের ব্যাপকতাকে অতিক্রম করে যায়।
(৪) অবরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। তাই এখানে যুক্তিবাক্য সত্য হলে সিদ্ধান্ত সত্য হয়। আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্যকে অতিক্রম করে যায়। তাই এখানে যুক্তিবাক্য সত্য হলে সিদ্ধান্ত সত্য হবে, না, মিথ্যা হবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।
(৫) অবরোহ যুক্তিতে যুক্তিবাক্যের সংখ্যার সঙ্গে সিদ্ধান্তের সত্য হওয়া-না-হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আরোহ যুক্তিতে যুক্তিবাক্যের সংখ্যার উপর সিন্ধান্তের সত্য-হবার সম্ভাবনা নির্ভর করে।
উপসংহার
আমরা যুক্তি গঠন করি এবং আশা করি যে, যুক্তির সিদ্ধান্ত সত্য হোক। আরোহ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত সত্য হতে পারে—এমন একটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত থাকে এবং অবরোহ যুস্তিতে সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণিত হয়। কাজেই অবরোহ যুক্তি এবং আরোহ যুক্তির গঠন পদ্ধতি ভিন্ন হলেও সত্যতা লাভের লক্ষ্যে এদের একটি অন্যের পরিপূরক।