ব্রিটেনের ক্যাবিনেট (মন্ত্রীসভা) শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূণে সাংবিধানিক রীতি বা প্রথার ওপর ভিত্তিশীল। ক্যাবিনেট ব্যবস্থা সম্পর্কিত নিয়মকানুন, ক্যাবিনেটের সঙ্গে রাজার, পার্লামেন্টের, প্রধানমন্ত্রীর, রাজনৈতিক দলের এবং নির্বাচকমণ্ডলীর সম্বন্ধ ব্রিটিশ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক রীতিনীতি। এগুলির মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলীর রাজনৈতিক সার্বভৌম অধিকার বাস্তবে কার্যকর হয়। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি (Features of British Cabinet) কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে আলোচনা করা হল।
(১) ক্যাবিনেটের কোন আইনগত ভিত্তি নেই: ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থানাধিকারী ক্যাবিনেটের কোন আইনগত ভিত্তি নেই। দীর্ঘদিনের কয়েকটি প্রচলিত প্রথা এবং সাংবিধানিক রীতিনীতির ওপর নির্ভর করে ব্রিটেনের ক্যাবিনেট ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৯৩৭ সালের রাজমন্ত্রী আইনে ক্যাবিনেট আইনগত স্বীকৃতি লাভ করেছে।
(২) ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থা মূলত দলীয় শাসন ব্যবস্থা: ব্রিটেনের ক্যাবিনেটের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থা মূলত দলীয় শাসন ব্যবস্থা। ক্যাবিনেট সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্য থেকে মনোনীত হন। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে এবং এটি ক্যাবিনেট ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কিন্তু সম্মিলিত সরকার গঠিত হলে এই মূলনীতি ব্যাহত হয়, কারণ সম্মিলিত সরকার বিভিন্ন দলের সদস্য নিয়ে গঠিত।
(৩) শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক: যে দল কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, সেই দল মন্ত্রিসভা গঠন করে। শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের প্রয়োজনীয়তার জন্যে ক্যাবিনেট সদস্যদের পার্লামন্টের সদস্য হতে হয়। কোন ব্যক্তি পার্লামেন্টের সদস্য না হয়েও সাময়িকভাবে ক্যাবিনেট সদস্য নিযুক্ত হতে পারেন, কিন্তু ক্যাবিনেট সদস্যপদ লাভের ছয় মাসের মধ্যেই তাঁকে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হবে। তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে কমন্সসভার সদস্য হতে পারেন, অথবা রাজার মনোনীত সদস্য হিসাবে লর্ডসভার সদস্য হতে পারেন।
(৪) কমন্সসভার নিকট মন্ত্রিদের যৌথ দায়িত্বঃ ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কমন্সসভার নিকট মন্ত্রিদের যৌথ দায়িত্ব। লর্ড মর্লে বলেছেন যে, মন্ত্রিসভার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হল ঐক্যবদ্ধ ও অবিভাজ্য দায়িত্ব। আইনত রাজাকে পরামর্শ দানের জন্য মন্ত্রীরা দায়ী থাকেন, কারণ রাজা কোন অন্যায় করতে পারেন না। কিন্তু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মন্ত্রীদের রাজনৈতিক দায়িত্ব, যৌথ দায়িত্বের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
(৫) ঐক্যবদ্ধ: ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর ঐক্যবদ্ধ ভাব। পার্লামেন্টের ভিতরে বিভিন্ন মন্ত্রিদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশ্যভাবে উপস্থিত করা যাবে না। বাইরের জগৎ জানবে যে, ক্যাবিনেটের যে-কোন সিদ্ধান্তের পিছনে সকলের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন রয়েছে।
(৬) প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য: ব্রিটেনের ক্যাবিনেটের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য সমান পদমর্যাদাসম্পন্ন হলেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত এবং তাঁকে ভিত্তি করেই ক্যাবিনেটের কাজ পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের নেতা, সুতরাং অন্যান্য মন্ত্রী অপেক্ষা তার মর্যাদা স্বাভাবিক কারণেই বেশি। তিনি তাঁর সহকর্মীদের মনোনীত করেন এবং কোন মন্ত্রির সঙ্গে মতবিরোধ হলে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। দলীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
(৭) নিয়মতান্ত্রিক শাসকের অনুপস্থিতি: ব্রিটিশ ক্যাবিনেট ব্যবস্থার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক শাসকের অনুপস্থিতি। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক অপরিহার্য। কিন্তু ইংল্যান্ডে প্রথম জর্জের আমল থেকে রাজা বা রানী ক্যাবিনেট বৈঠকে উপস্থিত থাকেন না। সুতরাং ব্রিটেনের ক্যাবিনেটে রাজা বা রানীর অনুপস্থিতি একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(৮) মন্ত্রিসভার গোপনীয়তা রক্ষা: গোপনীয়তা রক্ষা ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার আর একটি বৈশিষ্ট্য। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবার জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের ব্যক্তিগত মতভেদ যাতে সাধারণের সামনে প্রকাশ না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ও কূটনৈতিক প্রয়োজনে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পক্ষে গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজন আছে।
(৯) সাংবিধানিক রীতিনীতির ওপর নির্ভরশীলঃ ব্রিটেনের ক্যাবিনেট ব্যবস্থা প্রধানত সাংবিধানিক রীতিনীতির ওপর নির্ভরশীল। সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবিধানিক রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে ক্যাবিনেটের ক্ষমতা ও ভূমিকার পরিবর্তন ঘটেছে।