ধর্মপাল ছিলেন প্রাচীন বাংলা তথা পাল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি সুদক্ষ যোদ্ধা ও কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি পাল বংশের আঞ্চলিক রাজ্য বাংলাকে একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। গুজরাটি করি সোঢ়ঢল তাঁকে ‘উত্তরাপথস্বামীন’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি রাষ্ট্রকূট-রাজ পরবলের কন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন।
ত্রি-শক্তির যুদ্ধ
হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিলে তিনটি শক্তি আর্যাবর্তে প্রাধান্য স্থাপনের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এই তিনটি শক্তি হল বাংলার পাল বংশ, মালবের গুর্জর-প্রতিহার বংশ এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ গাঙ্গেয় উপত্যকা ও হর্ষের স্মৃতিবিজড়িত কনৌজ দখলই ছিল তিনটি শক্তির প্রধান উদ্দেশ্য। সে যুগে কনৌজের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছিল মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তিনটি শক্তির মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ‘ত্রি-শক্তির যুদ্ধ ‘নামে পরিচিত।
রাজ্যজয়
ধর্মপাল সিংহাসনে বসেই মগধ, বারাণসী ও প্রয়াগ দখল করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে প্রতিহার-বংশীয় বৎসরাজ তাঁকে বাধা দেন। এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। বৎসরাজ তাঁর বিজয় স্থায়ী করার পূর্বেই দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট-অধিপতি ধ্রুব তাঁর উপর আক্রমণ হানেন। পরাজিত বৎসরাজ রাজপুতানার মরু অঞ্চলে আশ্রয়গ্রহণে বাধ্য হন। এরপর ধ্রুব ধর্মপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। দোয়াব অঞ্চলে ধর্মপাল পরাজিত হন। অচিরেই রাষ্ট্রকূট-অধিপতি ধ্রুবও দাক্ষিণাত্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, রাষ্ট্রকূট অভিযানের ফলে ধর্মপালের লাভ হয়। এর ফলে বৎসরাজের ক্ষমতা প্রবলভাবে খর্ব হয়। প্রতিহার শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মপাল আর্যাবর্তের এক বিস্তীর্ণ স্থানে নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন। ভাগলপুরে প্রাপ্ত নারায়ণপালের তাম্রপট থেকে জানা যায় যে, কনৌজ তাঁর অধিকারে আসে এবং কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধ-কে বিতাড়িত করে তিনি নিজ মনোনীত প্রার্থী চক্রায়ুধ-কে সিংহাসনে বসান।
মুঙ্গের তাম্রপট থেকে জানা যায় যে, তিনি কনৌজ অতিক্রম করে কেদার ও গোকর্ণ দখল করেন। কেদার ও গোকর্ণ বলতে যথাক্রমে গাড়োয়াল ও নেপালকে বোঝায়। তিনি ইন্দ্ররাজ প্রভৃতি জয় করে মহোদয় অর্থাৎ কান্যকুব্জ অধিকার করেন। ধর্মপাল কান্যকুব্জ অধিকার করে ক্রমে সিন্ধুনদ ও পঞ্জাবের উত্তরে হিমালয়ের পাদভূমি পর্যন্ত জয় করেন। তিনি আর্যাবর্তের সার্বভৌমত্ব লাভ করার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবার জন্য কনৌজে (কান্যকুব্জ) একটি দরবারের অনুষ্ঠান করেন এবং দরবারে উপস্থিত রাজন্যবর্গ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। মালদহের নিকটবর্তী খালিমপুরে প্রাপ্ত ধর্মপালের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ভোজ (বেরার), মৎস্য (আলওয়ার ও জয়পুর), মদ্র (মধ্য পাঞ্জাব), কুরু (পূর্ব পাঞ্জাব), যদু (পাঞ্জাবের সিংহপুর), যবন (উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ), অবর্তী (রাজপুতানা), গান্ধার (পশ্চিম পাঞ্জাব) ও কীর (পাঞ্জাবের কাংড়া অঞ্চল) প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। মুঙ্গের লিপি ও গুজরাটি কবি সোঢ়ঢলের ‘উদয়সুন্দরী কথা’ কাব্যে খলিমপুর তাম্রলিপির বক্তব্য সমর্থিত হয়েছে।
আর্যাবর্তে ক্ষমতার পুনঃ প্রতিষ্ঠা
ধর্মপাল বেশিদিন নিশ্চিন্তে সাম্রাজ্য ভোগ করতে পারেন নি। প্রতিহার-বংশীয় বৎসরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ দখল করেন ও ধর্মপালকে পরাজিত করেন। ইতিমধ্যে আবার রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় গোবিন্দ আর্যাবর্তে এসে দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেন। তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে আর্যাবর্তে পুনরায় এক রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয় এবং এর সুযোগ নিয়ে ধর্মপাল তাঁর ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর এই ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ ছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, এই সমগ্র অঞ্চলটিতে ধর্মপালের প্রত্যক্ষ শাসন ছিল না। কেবলমাত্র বাংলা ও বিহারেই তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপিত ছিল এবং বিহারের সীমান্ত থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর অধীনে স্বশাসন ভোগ করত। এছাড়া পাঞ্জাব, পূর্ব রাজপুতানা, মালব, বেরার প্রভৃতি অঞ্চল অভ্যন্তরীণ স্বশাসন ভোগ করত। ধর্মপালের উপাধি ছিল ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’।
কৃতিত্ব
ধর্মপালের রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কেবলমাত্র বাংলার অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাই নয়—আর্যাবর্তের এক ব্যাপক স্থানে তিনি বাংলার আধিপত্য স্থাপন করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ধর্মপালের রাজত্বকাল “বাঙালির জীবনপ্রভাত”। তাঁর আমলে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভূত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। তিনি মগধে বিক্রমশীলা মহাবিহার, ওদন্তপুরী বিহার ও সোমপুরী বিহার স্থাপন করেন। এইসব বিহারে বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা হত। বিক্রমশীলা মহাবিহারে ১১৪ জন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত হরিভদ্র তাঁর গুরু ছিলেন। একটি তাম্রপটে তাঁকে ‘পরম-সৌগত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্য ধর্মের প্রতি তিনি সহনশীল ছিলেন। ধর্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাকপাল সেনাপতি ছিলেন এবং গর্গ নামে জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি নারায়ণের এক হিন্দু মন্দিরকে নিষ্কর ভূমি দান করেন। তাঁর শাসনকালে বাংলার আর্থিক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কৃষি ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলার সাহিত্য, শিল্প ও চিত্রকলা নবরূপ ধারণ করতে থাকে।