রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা পদ্ধতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য রয়েছে। গ্রীক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত সামান্য সংখ্যক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাস্তবধর্মী আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডারউইন এবং কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস প্রথম বাস্তবধর্মী ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত করেন। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নিত্যনতুন গবেষণা ও অগ্রগতি অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে উৎসাহিত করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বিগত চল্লিশ বছরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে সমাজবিদ্যা, মনোবিদ্যা, অর্থশাস্ত্র, পরিসংখ্যান তত্ত্ব প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি বিশেষভাবে অনুসৃত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে। আবার গতানুগতিক বা ঐতিহ্যগত পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতির সংযোজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অকাম্য জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সুতরাং ঐতিহ্যগত পদ্ধতি বা পরম্পরাগত পদ্ধতি ও আধুনিক পদ্ধতির পার্থক্য বিচার করা যেতে পারে।
ঐতিহ্যগত পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য [Characteristics of traditional approaches]
প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় দর্শন, ইতিহাস ও আইনের প্রধান ভূমিকা স্বীকার করাই হল ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গী বা পদ্ধতি। অতীত দার্শনিকগণ রাষ্ট্র ও মানুষের রাজনৈতিক জীবন, বিশ্ব-প্রকৃতিতে মানুষের স্থান প্রভৃতি বিষয়ে একটি আদর্শ কাম্য রূপ নির্ধারণ করে তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক, অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি সম্পর্কে মৌল নীতি স্থির করা প্রধান লক্ষ্য বলে গণ্য করতেন। পূর্বকল্পিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অবরোহ (Deductive) পদ্ধতিতে সমস্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদানই দার্শনিকদের মূল লক্ষ্য। বাস্তব রাজনৈতিক জগৎ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবার লক্ষ্য তাঁদের ছিল না। প্লেটো, রুশো, কান্ট, হেগেল, গ্রীন, ব্রাডলে, বোসাংকে প্রমুখ সকলে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক বর্ণনামূলক পদ্ধতি ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গীর পর্যায়ভুক্ত। এই পদ্ধতিতে ঐতিহাসিকদের রাষ্ট্রনায়কদের জীবনী, সাংবাদিকদের বর্ণনাবলী থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত তথ্যকে আপন বিচারবুদ্ধির সাহায্যে বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিক মূল বিষয়কে সুসংহত রূপদানের চেষ্টা করেন ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক পদ্ধতি মূলতঃ বর্ণনামূলক এবং সিদ্ধান্তসমূহ পরীক্ষা সাপেক্ষ। সুতরাং এই পদ্ধতিতে সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব হয় না।
তৃতীয়ত, ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গীর বর্ণনামূলক এবং প্রতিষ্ঠানগত আলোচনার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমান কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সনাতন পদ্ধতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন না।
চতুর্থত, ঐতিহ্যগত পদ্ধতি এবং আধুনিক পদ্ধতির যোগসূত্র হল তুলনামুলক পদ্ধতি। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অ্যারিস্টটল, বোদা, মন্টেস্কু প্রমুখ লেখকদের তুলনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
আধুনিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য [Characteristics of modern approaches]
বিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগত ও আইনগত রূপ ও বিভিন্ন কার্যাবলীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার যথার্থ উপলব্ধি করা যায় না বলে সমালোচনা করা হয়। মানুষের রাজনৈতিক আচরণ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এই সিদ্ধান্তের পেছনে বিভিন্ন প্রভাবের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা বাস্তবধর্মী হয়ে উঠবে বলে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থকগণ বিশ্বাস করেন। আচরণমূলক পদ্ধতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করলে ঐতিহ্যগত পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক পদ্ধতির পার্থক্য সুস্পষ্ট হবে।
প্রথমত, আচরণবাদ কাঠামো, প্রতিষ্ঠান ও ভাবাদর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে মানুষের ও গোষ্ঠীর আচরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক আচরণ, ব্যক্তিত্ব, সামাজিক সংগঠন ও সমাজের প্রকাশ ভিন্ন কিছু নয়। সুতরাং বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান অর্থাৎ সামাজিক মনোবিদ্যা, অর্থশাস্ত্র, সাংস্কৃতিক, নৃতত্ব প্রকৃতির তত্ত্ব ও পদ্ধতির সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, এই পদ্ধতি তত্ত্বকে বাস্তবধর্মী করবার জন্য তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
চতুর্থত, রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য আচরণবাদীদের সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে বলেন।
পঞ্চমত, আচরণবাদী আলোচনা হবে মূল্য-নিরপেক্ষ, বাস্তব বিশ্লেষণ থেকে নৈতিক মূল্যায়নকে পৃথক করতে হবে।
মূল্যায়ন: গ্রাহাম ওয়ালাস, আর্থার বেন্টলী, চার্লস মেরিয়াম, লাসওয়েল, ইস্টন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আধুনিক পদ্ধতির সমর্থক। আধুনিক পদ্ধতি মানুষের আচার-আচরণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে গ্রহণ করে। উভয় পদ্ধতির পার্থক্য ও সীমাবদ্ধতা মনে রেখে বলা যায় যে আচরণমূলক ও প্রতিষ্ঠানগত কোন পদ্ধতিই এককভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সম্পূর্ণ পদ্ধতি বলে গণ্য করা যায় না, উভয়ের সাহায্য বা সমন্বয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় কাম্য।