জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব
সার্বভৌমত্বের চরম, অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য আইনগত অর্থটি পরম্পরাগত বা একত্ববাদ মতবাদ বলে পরিচিত। একত্ববাদের দুই দিক কল্পনা করা যায়—পূর্ণ তত্ত্বগত এবং বাস্তব। প্রথম অর্থ অনুযায়ী রাষ্ট্র হল এক এবং অদ্বিতীয় সংগঠন, রাষ্ট্রের অর্থ অনুযায়ী একত্ববাদ সংঘের অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু সংঘগুলি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে স্বীকার করা হয়। এ দুই অর্থে সার্বভৌমত্বের আইনগত ব্যাখ্যাকেই পরম্পরাগত মতবাদীরা একত্ববাদ বা অস্টিনের মতবাদ বলে প্রচার করে থাকেন। বোঁদা, হবস্, বেন্থামের এবং অস্টিনই হলেন একত্ববাদের প্রধান প্রবক্তা।
আইনগত সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা ইরেজ আইনবিদ জন অস্টিনের (John Austin) রচনায় পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩২ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “Lectures on Jurisprudence” গ্রন্থে অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের স্বরূপ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন। সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী হবস্ (Hobbes) এবং বেন্থাম (Bentham)-এর রচনায় প্রকাশিত হয়েছিল। অস্টিন, হবস ও বেন্থামের ধারণাকে গ্রহণ করলেও তাঁর তত্ত্ব সার্বভৌমত্বের যুক্তিযুক্ত, বাস্তব এবং বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করা যায়। বোঁদা, হবস, বেন্থাম ও অস্টিনের মতবাদ একত্ববাদ (Monism) বলে পরিচিত।
অস্টিনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ: অস্টিন ছিলেন আইনবিদ এবং আইনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে তিনি সার্বভৌমত্বেরও প্রকৃতি বিচার করেছেন। অস্টিনের মতানুযায়ী সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতন বা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ অধস্তনের স্বাভাবিক ও অভ্যাসগত আনুগত্যের জন্য স্বততই কার্যকর। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশের পিছনে চরম কর্তৃত্বের অসীম শক্তি বর্তমান, যা অধস্তন ব্যক্তিগণ অমান্য করতে সাহসী হন না। অস্টিন বলেন, “যখন কোন সমাজে নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ-কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুগত্য স্বীকার না করে সে সমাজের অধিকাংশের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে, তা হলে সে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সে সমাজে সার্বভৌম এবং সার্বভৌমত্বসহ সে সমাজ “রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ”।
সংজ্ঞাটির বৈশিষ্ট্য: অস্টিনের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:
- প্রতিটি রাজনৈতিক সমাজে এমন একটি মানবীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকে যা রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা ব্যবহার করে।
- এ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সুনির্দিষ্ট, এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনরকম ভুল বুঝবার সম্ভাবনা নেই।
- এ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা বাইরে অপর কারও নিকট আনুগত্য প্রকাশ করে না।
- এ কর্তৃপক্ষ জনগণের অধিকাংশের নিকট অভ্যাসগত আনুগত্য লাভ করে থাকে।
- রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর এ ক্ষমতা চরমভাবে প্রযোজ্য। এ ক্ষমতা অসীম ও অবিভাজ্য।
সুতরাং অস্টিনের মতে সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিহত, অসীম ক্ষমতা যা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ব্যবহার করে। আইন হল সার্বভৌমের আদেশ। সার্বভৌমের আদেশ বা আইন মানতে সমাজের সকলেই বাধ্য।
সমালোচনা
অস্টিনের সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞাটির যে সমালোচনা করা হল তা হল—
(১) রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করে: সমালোচকগণের মতে অস্টিন তাঁর সার্বভৌমত্ব তত্ত্বে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ভূমিকা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের পেছনে যে শক্তি কাজ করে, চূড়ান্ত পর্যায়ে আইনগত সার্বভৌমত্বকে তার নিকট নতি স্বীকার করতে হয়। ব্রিটেনের উদাহরণ হতে বলতে পারা যায় যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের চরম কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু পার্লামেন্ট জনগণের সকল অধিকার অপহরণের জন্য কোন আইন পাস করতে পারে না। এ ধরনের আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হলে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের জোয়ারে সে আইন ভেসে যাবে, আইন বলবৎ করার কোন সুযোগ ঘটবে না। সুতরাং রাজনৈতিক সার্বভৌমের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। অস্টিন এ ভূমিকা উপেক্ষা করেছেন।
(২) গণতান্ত্রিক আদর্শবিরোধী: অস্টিনের সার্বভৌমত্ব জনগণের ইচ্ছা বা অধিকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত। সার্বভৌমের ইচ্ছাপ্রসূত পীড়নমূলক আইন গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রসারের সঙ্গে অস্টিনের ব্যাখ্যার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।
(৩) সমাজের শ্রেয়বোধের সঙ্গে একীভূত: অসিনের তত্ত্বের অন্যতম খ্যাতনামা সমালোচক হেনরী মেইনের (Henry Maine) মতে, সমাজের এমন কতকগুলি রীতিনীতি আছে, যা সমাজের শ্রেয়বোধের সঙ্গে একীভূত হয়ে নিত্যবহমান। চরম স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে এগুলি উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। কোন স্বৈরাচারী শাসকই সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, ধর্মীয় অনুশাসনকে ক্ষুণ্ণ করতে সাহসী হন নি। এ সমালোচনার উত্তরে অস্টিনের অনুগামীগণ বলেন, সার্বভৌম শক্তি ও রীতিনীতিগুলি অভিপ্রেত মনে না করলে ক্ষুণ্ণ করবার প্রয়োজন ঘটে না। সুতরাং সার্বভৌমত্ব যা অনুমোদন করে, তা-ই আদেশ।
(৪) আইনের উৎস সম্পর্কে ভুল ধারণা: আইনের প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে অস্টিনের দৃষ্টিভঙ্গীরও সমালোচনা করতে হয়। ঐতিহাসিক পদ্ধতির বিশ্লেষণে আইন সমাজের গঠন-প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়, কোন আইনপ্রণেতার ইচ্ছায় নয়। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গীতে ডুগুই (Duguit) এবং ক্র্যাব (Krabbe) আইনকে সামাজিক প্রয়োজনের ফল বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং এদের মতে সার্বভৌমই আইনের উৎস এ ধারণা সঠিক নয়।
(৫) বহুত্ববাদী ও আন্তর্জাতিকতাবাদী সমালোচনা: বহুত্ববাদিগণ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদিগণ অস্টিনের সার্বভৌমত্বের বিশেষ সমালোচনা করেছেন। সার্বভৌমের অসীম চরম ক্ষমতা তারা স্বীকার করেন নি। বহুত্ববাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্র অন্যতম সামাজিক সংগঠন মাত্র সমাজের অন্যান্য সংঘ বা প্রতিষ্ঠানও নিজ নিজ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। রাষ্ট্র এদের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আন্তর্জাতিকতাবাদীগণ রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌম ক্ষমতা শান্তি ও শৃঙ্খলার অন্তরায় এবং মানবতাবিরোধী বলে গণ্য করেন।
(৬) যুক্তরাষ্ট্রে প্রযোজ্য নয়: যুক্তরাষ্ট্রীয় তত্ত্বের ভিত্তিতেও অস্টিনের সার্বভৌমত্বের সমালোচনা করা হয়। অসিন যখন তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন তখনও আধুনিক রাষ্ট্র শৈশবাবস্থায় ছিল। সেই কারণে তাঁর ব্যাখ্যা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রযোজ্য নয়। অস্টিনের ধারণা অনুযায়ী কোন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সন্ধান যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় না।
মূল্যায়ন
সাম্প্রতিক কালের অনেক লেখক পূর্বসুরীদের ন্যায় আবেগের প্রশ্রয় দেন নি। অস্টিন সম্পর্কে তাঁরা নতুনভাবে মূল্যায়ন করেছেন। অস্টিন সম্পূর্ণ পাশবিক শক্তির ওপর তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা অনেকেই স্বীকার করেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভূতপূর্ব অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অস্টিনের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি সহকারে আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, জনগণের স্বভাবজাত আনুগত্য সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তি হলে, এ ক্ষমতার স্থায়িত্ব চূড়ান্তভাবে জনগণের সম্মতি-নির্ভর। সুতরাং শাসকের ক্ষমতা চূড়ান্ত বিচারে শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা অস্টিন অস্বীকার করেন নি।
অস্টিন ছিলেন আইনবিদ, তাই আইনের দৃষ্টিতেই তিনি সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক গার্নারের মতে, সার্বভৌমত্বের আইনগত প্রকৃতি সম্পর্কে অস্টিনের তত্ত্ব সকল দিক বিচারে সুস্পষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত। আইনগত সার্বভৌমত্ব ধারণাকে অস্টিন পূর্ণতা দিয়েছেন স্বীকার করতে হয়। কিন্তু সার্বভৌমত্ব ও পাশবিক বল অস্টিনের চিন্তায় সমার্থবাচক ছিল না, তা অনেক সমালোচক উপেক্ষা করেছেন। অস্টিনের তত্ত্বের উল্লেখ্য দিক হল রাজনৈতিক ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করে আইনগত সার্বভৌমত্বের ওপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ। এখানেই অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা। সেই কারণে তাঁর মতবাদকে ভ্রান্ত না বলে অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট বলা যেতে পারে।