সমাজবিজ্ঞানী মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিখ্যাত “Revolution and Counter Revolution in China” গ্রন্থে তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “বহু কলঙ্কিত, ভ্রান্ত ভাবে বিশ্লেষিত এবং স্বল্পবোধ্য তাইপিং বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে উত্তরণ ঘটেছিল”। মানবেন্দ্রনাথ রায় ফরাসী বিপ্লবের সাথে তাইপিং বিদ্রোহের (Taiping Rebellion) সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। কারণ, ফরাসী বিপ্লবের মতো তাইপিং বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণী এবং পরবর্তী স্তরে কৃষকরা অংশগ্রহণ করেছিল।
আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, তাইপিং বিদ্রোহের সময় চীনে অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের মতো বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে ওঠেনি। চীনের জেন্ট্রির তাইপিং বিদ্রোহে কোন ভূমিকাই ছিল না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তাইপিং বিদ্রোহীদের ক্ষোভের শিকার হয়েছিলেন এবং তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই তাইপিং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা যথার্থই বলেছেন যে, তাইপিং বিদ্রোহকে কোনমতেই বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসাবে আখ্যায়িত করা সমীচীন হবে না এবং ফরাসী বিপ্লবের সাথে তাইপিং বিদ্রোহের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
জার্মান পণ্ডিত উলফগ্যাং ফ্রাঙ্ক (Wolfgang Frank) বলেছেন, তাইপিং বিদ্রোহের নেতৃত্বের দিকটি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তাইপিং বিদ্রোহের প্রথম সারির প্রায়ই নেতা উঠে এসেছিলেন দরিদ্র শ্রেণী থেকে। বিদ্রোহের নেতৃত্ব বিদ্রোহের শ্রেণী চরিত্র প্রতিফলিত করেছিল। দরিদ্র কৃষক, খনি-মজুর, জলদস্যু প্রভৃতিরা তাইপিং বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন।
জ্যা শোনোর মতে, একদল দরিদ্র, হতাশ, জীবনযুদ্ধে পরাজিত ব্যক্তি ‘ঈশ্বর ভক্ত সমিতি’ গঠন করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। শোনো তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে কৃষক বিদ্রোহের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। তাইপিং বিদ্রোহ দক্ষিণ চীনে আরম্ভ হবার পর বিদ্রোহীরা মধ্য চীন ধরে ইয়াংসি নদীর নিম্ন উপত্যকার দিকে অগ্রসর হয়েছিল। সেই সময় ‘মহতী শান্তি’ প্রতিষ্ঠাকারী সৈন্যদের অর্থাৎ তাইপিং বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা অত্যাচারী জমিদার এবং জনস্বার্থবিরোধী রাজপুরুষদের নিহত করেছিল। জমির দলিল থেকে আরম্ভ করে ঋণপত্র ও মহাজনের কাছে রক্ষিত যাবতীয় নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিক থেকে তাইপিং বিদ্রোহকে কৃষক অভ্যুত্থান হিসাবে চিহ্নিত করা অযৌক্তিক হবে না।
তাইপিং বিদ্রোহে আধুনিকতার সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে কৃষক কল্পরাজ্য (Peasant Utopia) ও মাঞ্চু-বিরোধী জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি প্রথাগত ধ্যানধারণার সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা মাঞ্চু শাসনের অবসান ঘটিয়ে সিংহাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। তারা “মহতী শান্তির স্বর্গরাজ্য” প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া, তাইপিংদের পৌত্তলিকতার তীব্র বিরোধিতা এবং নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের ঘোষণার মধ্যেও আধুনিকতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদার আসনে বসিয়ে তাইপিং-রা কনফুসীয় ঐতিহ্যের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের নতুন তাইপিং ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
“The Land System of the Heavenly Kingdom” দলিল থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাইপিংদের মধ্যে সমতাভিত্তিক সমাজ (Egalitarian Society) গড়ে তোলার ব্যাপারে একটি স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাইপিং স্বর্গরাজ্যে জমি ও সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উক্ত দলিলে বলা হয়েছিল, স্বর্গের নীচে সমস্ত জমি স্বর্গের নিচের যাবতীয় মানুষ একত্রিত হয়ে চাষ করবে। স্বর্গরাজ্যের রাজা হুং শিউ চুয়ান নিজেকে যীশুখ্রিস্টের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলে ঘোষণা করে পশ্চিমীদের সাথে চীনাদের সমপর্যায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। ধর্মীয় সমতার বিষয়টির সাথে প্রায় সমসাময়িক কালে সংঘটিত মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলের “Black Christ” আন্দোলনের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তাইপিংদের সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।
তাইপিংদের নীতিজ্ঞান ছিল অসামান্য। নৈতিক চরিত্র গঠনের বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তাইপিং স্বর্গরাজ্যে আফিমের নেশা, জুয়া খেলা, গণিকাবৃত্তি, নারীদের সাথে ব্যভিচার প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাছাড়া জনকল্যাণমূলক কর্তব্যের প্রতি তাইপিংদের প্রবল আগ্রহ ছিল। শরণার্থী ও দরিদ্রদের ত্রাণ দেবার কাজে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সু-চাও অঞ্চলে ভূস্বামীদের প্রতিহিংসাপরায়ণ আক্রমণের ফলে যে সমস্ত দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাদের তাইপিংদের তরফ থেকে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা দরিদ্রদের মধ্যে ১ লক্ষ তাম্রমুদ্রা বিলি করেছিলেন।
তাইপিং অভ্যুত্থানের সমসাময়িককালে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস তাইপিং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব হবে চীনা প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি। বস্তুত তাইপিং অভ্যুত্থান একটি অসমাপ্ত ও অপূর্ণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব না কৃষক বিদ্রোহ তা নিয়ে বিতর্ক থেকে গেছে। তাইপিং বিপ্লবীরা তাঁদের প্রচারে বা ইস্তাহারে কৃষি বিপ্লবের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেননি। কিন্তু তাইপিং বিদ্রোহীরা অধিকাংশই এসেছিলেন কৃষক পরিবার থেকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষু যখন তাইপিং বিপ্লবীদের দমন করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন তাইপিং বিপ্লবীরা অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন কৃষকদের কাছ থেকে। কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, কৃষক স্বার্থে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী এবং সর্বোপরি কৃষক কল্পরাজ্য গড়ে তোলার বাসনা অবশ্যই তাইপিং বিদ্রোহকে একটি সামন্ততন্ত্র বিরোধী সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রূপ দিয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা তাইপিং বিদ্রোহের অভিজ্ঞতাকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে প্রথম কৃষি বিপ্লব হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।