গুরু গোবিন্দ সিংহ (Guru Gobind Singh) ছিলেন দশম তথা শেষ শিখ গুরু। তিনি একজন যোদ্ধা এবং দার্শনিক ছিলেন। তিনি 1666 খ্রিস্টাব্দের 22 ডিসেম্বর বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন। গুরু তেগ বাহাদুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গোবিন্দ সিংহ 1675 খ্রিস্টাব্দের 11 নভেম্বর মাত্র নয় বছর বয়সে গুরুর পদে বসেন। তিনি তাঁর সংগঠন নীতির দ্বারা শিখ জাতিকে জাতীয় ঐক্য ও ধর্মীয় আদর্শবাদে উদ্দীপিত করেন। শিখ নেতা হিসেবে গুরু গোবিন্দ সিং-এর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল 1699 খ্রিস্টাব্দে “খালসা” প্রতিষ্ঠা।
গুরু গোবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে “মুঘল-শিখের সংঘাত শিখ জাতির ধর্মযুদ্ধে” পরিণত হয়। গুরু গোবিন্দ খালসা বাহিনীকে দৃঢ় করার সঙ্গে সঙ্গে শিখদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ৫০০ বাছাই করা ভাড়াটিয়া আফগান সেনা নিযুক্ত করেন। গুরু গোবিন্দ তাঁর সংগঠিত শিখ সামরিক বাহিনীর নাম দেন “খালসা” বা পবিত্র। খালসা গোষ্ঠীতে যোগদানের জন্য তিনি “পাহুল” বা দীক্ষা প্রথার প্রবর্তন করেন। শিখপন্থের জন্য জীবন, সম্পত্তি উৎসর্গ করার শপথ পাহুল প্রথার দ্বারা খালসা সদস্যরা গ্রহণ করেন। গুরু গোবিন্দ শিখদের শিখপন্থের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য দীক্ষিত শিখদের পূর্ববর্তী উপাধি ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। সকল শিখ এখন থেকে সিং বা সিংহ উপাধি গ্রহণের নির্দেশ পায়। এভাবে তিনি শিখদের একটি সংহত সম্প্রদায়ে পরিণত করেন।
গুরু গোবিন্দ সিংহ খালসাদের পঞ্চ “ক” ধারণের নির্দেশ দেন। এই পাঁচ “ক” ছিল—কেশ, কঙ্কতি বা চিরুণী, কাচ্ছা বা আঁটো পায়জামা, কড়া বা কব্জীতে লোহার বালা এবং কৃপাণ বা তরবারি। গুরু গোবিন্দ তাঁর শিষ্যদের হিন্দুশাস্ত্র বর্জন করে কেবলমাত্র গ্রন্থসাহেবকে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্ররূপে জ্ঞান করতে নির্দেশ দেন। হিন্দু দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে গুরু নানকের প্রবর্তিত নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করতে তিনি সকল শিখকে উপদেশ দেন। তিনি জাতিভেদ প্রথা ত্যাগ করেন। তিনি সকল শিখ বা শিষ্যকে সমান বলে ঘোষণা করেন। সর্বোপরি, তিনি শিখদের একটি সামরিক ধর্মীয় সম্প্রদায়রূপে সংগঠন করেন।
গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখ পঞ্চায়েত বা পন্থকেই শিখদের মধ্যে সার্বভৌম বলে ঘোষণা করেন। শিখপন্থ সার্বভৌম শক্তির আধার ঘোষিত হওয়ার ফলে গুরু গোবিন্দের মৃত্যুর পর গুরুর পদ লোপ পায়। গুরু গোবিন্দ ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে পন্থ ও খালসা মন্ডলের মধ্যেই গুরু অবস্থান করবেন। কোন বিশেষ ব্যক্তি গুরু থাকবেন না। ড. খুশবন্ত সিংহের মতে, “গুরু গোবিন্দ সিংহের সংস্কারের ফলে স্বল্পকালের মধ্যে শান্তিপ্রিয় শিখরা এক যুদ্ধপ্রিয় ধর্ম-বিশ্বাসী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।” শুধু আনন্দপুরে ২০ হাজার জাঠ শিখ ধর্ম গ্রহণ করে ও খালসা বাহিনীতে যোগ দেয়।
গোবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায় (Sikh community) সংগ্রামী জীবনধারা গ্রহণ করায় প্রতিবেশী শক্তিগুলি ভীত হয়। পাঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চলের হিন্দু রাজাদের সঙ্গে খালসা গোষ্ঠীর যুদ্ধ-বিগ্রহ আরম্ভ হয়। এই সকল রাজ্য মুঘলদের সাহায্য যোগাড় করে গোবিন্দের প্রধান কর্মকেন্দ্র আনন্দপুর অবরোধ করে। এই আক্রমণের ফলে আনন্দপুরের পতন হয় এবং গোবিন্দের পুত্রগণ মুঘলদের হাতে নিহত হন। এই বিপর্যয়ের মধ্যেও গোবিন্দ সিংহ অবিচলিত থাকেন। তিনি “গ্রন্থ সাহেবের” সম্পাদনা করে “দশম পাদশা কি গ্রন্থ” নামে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর নীতি ও আদর্শ প্রচার করেন। গুরু গোবিন্দের সংগঠন শিখ জাতিকে নববলে বলীয়ান করে। ধর্মবিশ্বাস ও সামরিক কর্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তিনি শিখ সম্প্রদায়কে ‘সামরিক চরিত্র’ দান করেন।
গুরু গোবিন্দ নানকের জন্মস্থান তালবন্দী থেকে বাদশাহ ঔরঙ্গজেবকে এক পত্র দ্বারা আবেদন করেন যে, তিনি যেন তাঁর সুবাদার ওয়াজির খানকে শিখদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। ঔরঙ্গজেব গুরুর আবেদন মঞ্জুর করেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে, তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারের জন্য তাঁর পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই গৃহযুদ্ধে গুরু গোবিন্দ বাহাদুর শাহের পক্ষ নেন এবং জাজুর যুদ্ধে বাহাদুর শাহের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য শিখ বাহিনী পাঠান। তিনি বাহাদুর শাহের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে যান। গুরু গোবিন্দ সিংহ এই সময় ওয়াজির খান কর্তৃক নিযুক্ত দুই আফগান ঘাতক দ্বারা অতর্কিত আক্রমণের দ্বারা আহত হন এবং কয়েক দিন পরে 1708 খ্রিস্টাব্দর 7 অক্টোবর ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যান। গুরু গোবিন্দের মৃত্যুর পর কোন আনুষ্ঠানিক শিখ গুরুর পদ ছিল না।