পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রে দলপ্রথা একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বার্কার বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট ও দলপ্রথা বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত’। জনগণের বিচারে যে দলের নীতি ও আদর্শ সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য সেই দলই সরকার গঠন করে এবং অন্যান্য দলগুলি বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে। দলীয় ব্যবস্থার ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন পরিচালনা সম্ভব। সরকারী ও বিরোধী উভয় দলের পারস্পরিক আলোচনা সমালোচনা জনকল্যাণমূলক শাসনের বুনিয়াদ রচনা করে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টারী শাসনে দলীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই ব্রিটেন ক্যাবিনেট ও পার্লামেন্টের পারস্পরিক সম্পর্ক আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। ক্যাবিনেটের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আজ পার্লামেন্টের উপর ক্যাবিনেটের নিয়ন্ত্রণ হয়েছে।
ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ধারায় জাতীয় জীবনের প্রয়োজনানুযায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়েছে। ১৮৩২ সালের সংস্কার আইন (Reforms Act, 1832) পাস হওয়ায় পর ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলের সুস্পষ্ট চেহারা প্রকাশ পায়। অলিভার ক্রমওয়েলের সময় ‘ক্যাভেলিয়ার’ (Cavalier) এবং ‘রাউন্ডহেড’ (Roundhead) এই দুই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। ১৬৮৮ খ্রীস্টাব্দের গৌরবময় বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে ‘হইগ’ (Whig) এবং ‘টোরী’ (Tory) দলের প্রাধান্য দেখা যায়। ১৮৩২ সালের পর টোরী ও হইগ দল নতুন নাম গ্রহণ করে। এরা হল যথাক্রমে ‘রক্ষণশীল’ (Conservative) ও উদারনৈতিক (Liberal)। ১৯০০ সালের পূর্বে পার্লামেন্টে শ্রমিক দলের সদস্য থাকলেও কোন দলগত স্বীকৃতি ছিল না। ১৯০৬ সালে শ্রমিক দলের (Labour Party) উদ্ভব হয়।
ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
(১) দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার অবস্থান: রাজনৈতিক দলগুলির ধারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা করলে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, তা হল দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আইভর জেনিংস, হার্ভে ও বাথার প্রমুখ খ্যাতনামা লেখকগণ দ্বি-দল ব্যবস্থার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের প্রকৃতির স্বভাবিক শ্রেণীবিভাগের ভিত্তিকেই ব্রিটেনে দুটি দলের উদ্ভব। সমাজজীবনে পরিবর্তন এক স্বাভাবিক ঘটনা, যারা দ্রুতগতিতে পরিবর্তনের পক্ষপাতি তারা হলেন সংস্কারপন্থী। অপরদিকে যারা ধীরগতি পরিবর্তন চান, তারা রক্ষণশীল। (i) ধর্মীয় জাতিগত বা ভৌগোলিক উপাদানগুলি দুটি মূলগোষ্ঠীর মধ্যে উপ-বিভাজন সম্ভব করতে পারে নি। (ii) প্রয়োজনমত আপস সমঝোতা করবার মৌল দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় জীবনের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
(২) দলগুলি কর্মসূচী ভিত্তিক: ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলি কর্মসূচীভিত্তিক বলা হয়ে থাকে। নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন কর্মসূচী ও পন্থা গ্রহণের ব্যাপারে দলগুলি অনেক সময় অতিবাহিত করে।
(৩) শ্রেণী স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত: ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণ শ্রেণীভিত্তিক না হলেও শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গীতে অধিকাংশ জাতীয় সমস্যার বিচার-বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। সাধারণভাবে শ্রমিক দল সাধারণ মানুষ, শ্রমিক ও দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে; অন্যদিকে রক্ষণশীল দলের সদস্যরা জনগণের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে বলা যেতে পারে। অবশ্য উভয় দলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের অভাব রয়েছে।
(৪) দলীয় শৃঙ্খলা কঠোর ভাবে অনুসৃত হয়: ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। তুলনামূলকভাবে শ্রমিক দল অধিক সুসংগঠিত।
(৫) কেন্দ্রীয় সংগঠন শক্তিশালী: রাজনৈতিক দলগুলির আঞ্চলিক বা স্থানীয় সংগঠন অপেক্ষা কেন্দ্রীয় সংগঠন অধিক ক্ষমতার অধিকারী।
(৬) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা: ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ব্রিটেনের দল-ব্যবস্থাকে অভিনব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
ব্রিটেনের দলপ্রথার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট মনে রাখা প্রয়োজন। ব্রিটেনে রক্ষণশীল দল ২১ জন সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার ৫ বছর পরিচালনা করতে সক্ষম। ব্রিটেনে দলত্যাগ বিরোধী আইন না থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেনের পার্লামেন্টের কোন সদস্য নির্বাচকমণ্ডলীর মতামত উপেক্ষা করে দল বদল করবে একথা সাধারণ মানুষ চিন্তা করতে পারে না।