সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় সভা (Federal Assembly) নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় সভা দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত—যথা, রাজ্য পরিষদ (The Council of States) ও জাতীয় পরিষদ (The National Council)। রাজ্য পরিষদ ক্যান্টনগুলির প্রতিনিধিত্ব করে, আর জাতীয় পরিষদ হল জনসাধারণের প্রতিনিধিমূলক সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সভার গঠন [Composition]
রাজ্য পরিষদে ৪৪ জন সদস্য নির্বাচিত হন। প্রত্যেক ক্যান্টন থেকে দুজন করে এবং অর্ধ-ক্যান্টন থেকে একজন করে প্রতিনিধি থাকেন। এদের কার্যকাল ও নির্বাচন পদ্ধতি সম্বন্ধে নিয়মকানুন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রত্যেক ক্যান্টনের আছে। সেজন্য ঐ নিয়মের মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। কোন ক্যান্টনের প্রতিনিধির কার্যকালের মেয়াদ ৪ বছর, কোন ক্যান্টনে ৩ বছর, আবার কোন ক্যান্টনে ১ বছর মাত্র।
১৯৫০ সালের সংশোধন অনুযায়ী ২৪ হাজার অধিবাসীর জন্য একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়। সদস্যগণ সমানুপাতিক ভোট-পদ্ধতিতে (principle of proportional representation) জনসাধারণ কর্তৃক চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে জাতীয় পরিষদে ২০০ জন প্রতিনিধি আছেন। ২০ বছর বয়স্ক প্রত্যেক পুরুষ নাগরিক (নারীর ভোটাধিকার নেই) ভোটদানে সমর্থ, যদি ক্যান্টনের কোন আইন তাকে সক্রিয় নাগরিকতা থেকে বঞ্চিত না করে। সম্প্রতি এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে গণভোটের দ্বারা সুইজারল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে প্রথম নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
আইনসভার প্রত্যেক কক্ষ নিজ সদস্যগণের মধ্যে থেকে একজন সভাপতি ও একজন সহ-সভাপতি নির্বাচন করে। কোন বিষয়ে দু’পক্ষে সমান সংখ্যক ভোট হলে সংশ্লিষ্ট কক্ষের সভাপতির নির্ণায়ক ভোটে (casting vote) তার মীমাংসা হয়। দু’কক্ষের স্থায়ী নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে সাধারণ অধিবেশনে মিলিত হয়। জাতীয় পরিষদের এক-চতুর্থাংশ সদস্যের অথবা পাঁচটি ক্যান্টনের অনুরোধক্রমে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারে (“Both the Councils meet once a year in ordinary session on a day fixed by standing orders. Extra-ordinary meetings are summoned by the Federal Council, or on the request of one-quarter of the members, or of five Cantons.” — Article 86)। কার্য সম্পাদনের জন্য প্রত্যেক কক্ষে অধিকাংশ সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভোটপ্রদানকারী সদস্যগণের অধিকাংশের অনুমোদন প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সভার ক্ষমতা [Powers]
সংবিধান অনুযায়ী যে সকল ক্ষমতা অন্য কোন যুক্তরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত হয়েছে, তা ছাড়া সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইনসভার আছে। তাছাড়া শাসন ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচন, সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন, সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতা ও প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ ঘোষণা, শাস্তির বিষয় যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার কর্তৃত্বাধীন। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন করতেও এই সভা সমর্থ, তবে তা গণভোটে অধিক সংখ্যক ভোটদাতা ও অধিক সংখ্যক ক্যান্টন কর্তৃক গৃহীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নিয়ম আছে যে, ৩০ হাজার নাগরিক বা ৮টি ক্যান্টনের অধিবাসী দাবী করলে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার আইন, অধ্যাদেশ বা চুক্তি জনসাধারণের কাছে মতামতের জন্য পেশ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় সভার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের শাসন-সংক্রান্ত বিবাদ-বিসংবাদের বিরুদ্ধে আপীলের শুনানী হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলির মধ্যে অধিকার নিয়ে বিরোধ বাধলে তার বিচার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ও বিচারকার্যের তত্ত্বাবধান করে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা কিন্তু বিল উত্থাপন ও বিলের খসড়া রচনায় যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
উভয়কক্ষের সম্পর্ক [Bilateral relations]
রাজা পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ সংবিধান অনুযায়ী সমান ক্ষমতার অধিকারী। আয়-ব্যয় সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে দুই কক্ষের ক্ষমতার কোন পার্থক্য নেই। এই সম্পর্কে স্ট্রং (Strong) বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের শাসন বিভাগের মতো আইনসভারও অভিনবত্ব রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আইনসভার মধ্যে সুইস আইনসভারই উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের ক্ষমতায় কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। আইন পাস হলে উভয় কক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। দু’কক্ষের মতদ্বৈধতা হলে যুক্ত কমিটির মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। কতকগুলি ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের যুক্ত অধিবেশনও প্রয়োজন হয়। অবশ্য এরূপ যুক্ত অধিবেশনে জাতীয় পরিষদের প্রভাবই বলবৎ হবার সম্ভাবনা থাকে। সুইজারল্যান্ডে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতিতে আইনসভার মতো এত বিবিধ ক্ষমতা সাধারণত কোন আইনসভা ভোগ করে না।
সমালোচনা [Criticism]
সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার ক্ষমতা ব্যাপক মনে হলেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সভাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে হয়।
(১) গণভোট: সুইস সংবিধানর প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন থাকার ফলে আইনসভার প্রাধান্য ক্ষুন্ন হয়েছে। আইন প্রণয়নে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রীয় সভা নয়, সুইজারল্যান্ডের জনগণ। অনেক ক্ষেত্রে আইনসভা কর্তৃক গৃহীত বিল গণভোটে জনগণ কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়। সেই কারণে আইন সভার সদস্যগণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করতে হয়।
(২) যুক্তরাষ্ট্র পরিষদের দায়িত্বঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের দায়িত্ব ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ার জন্য শাসন-পরিষদের সদস্যগণ যোগ্যতার সঙ্গে দ্রুত কাজ সম্পাদন করতে পারেন। তা ছাড়া পুনর্নির্বাচনের জন্য সদস্যগণ অভিজ্ঞ ও দক্ষ হন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আইনসভা অপেক্ষা শাসন পরিষদ অধিক উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন।
(৩) সাম্প্রতিক গতি: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসনব্যবস্থায় বর্তমানে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতির জন্য শাসন বিভাগই অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েছে।
উপরোক্ত কারণগুলি জন্য আইনসভার প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হলেও সকল লেখক সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় সভাকে দুর্বল আইনসভা বলে অভিহিত করতে চান না। অধ্যাপক ক্রিস্টোফার হিউজেস-এর মতে, সামগ্রিক বিচারে সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভাকে দুর্বল বলে মনে করা যায় না; শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যস্থায় গৌরব ও মর্যাদার অধিকারী।