রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে বাস্তবে কার্যকর করবার মাধ্যম হল বিচার ব্যবস্থা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থার ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ এবং শ্রেণীদ্বয়ের অবসান ঘটবার ফলে শ্রেণী স্বার্থের কোন সংঘাত দেখা দেয় না। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব থাকে না। সমাজতান্ত্রিক আইনই প্রাধান্য লাভ করে এবং সমাজতান্ত্রিক আইনের দ্বারা সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ ও নাগরিকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যকে কার্যকর করবার জন্য বিচার বিভাগ সচেষ্ট হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে মার্কসবাদিগণ অলীক ধারণা মনে করেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁরা সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও অভিভাবক হিসেবে বিচার বিভাগের ভূমিকা স্বীকার করেন না। বিচার বিভাগের ভূমিকা সম্পর্কে মাও সে-তুং তাঁর “জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্ব” প্রবন্ধে সুস্পষ্ট সমালোচনা করেছেন। এই অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বিচার ব্যবস্থার স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে।
চীনের বিচার ব্যবস্থার লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার লক্ষ্যের সঙ্গে চীনের বিচার ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আইন দ্বারা সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় (৪ ধারা) এবং বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য নীতির প্রাধান্য স্বীকৃত (১৪৬ ধারা)। সমাজতান্ত্রিক নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা এবং সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে দমন করে সমাজতন্ত্রের দৃঢ় প্রতিষ্ঠাই বিচার ব্যবস্থার মুখ্য লক্ষ্য। চীনের বিচার ব্যবস্থার উদ্দেশ্যও অনুরূপ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক আইনের উদ্দেশ্যকে রূপায়িত করাই হল বিচার ব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য। সমাজতান্ত্রিক আইন ও জনগণের স্বার্থের ওপর যে-কোন আক্রমণ কঠোরভাবে দমন করবার কথা বলা হয়েছে। ১৯৮২ সালের সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণের ওপর গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণে আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিশেষ ভূমিকা স্বীকার করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র, পেটি-বুর্জোয়া ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ, উদারনৈতিক চিন্তাধারা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজতন্ত্রবিরোধী সকল ধ্যান-ধারণাকে প্রতিহত করবার জন্য আইন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে।
(১) সমাজতান্ত্রিক আইনকে রূপায়িত করবার মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করাও বিচার বিভাগের অন্যতম লক্ষ্য। সর্বোপরি সকল প্রতিবিপ্লবী শক্তি দমন করে জনগণের স্বার্থ ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সংবিধানে বিচার ব্যবস্থাকে সংগঠিত করা হয়েছে। পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগকে যে প্রাধান্য দেওয়া হয় চীনের সংবিধানে বিচার বিভাগ সেই প্রাধান্য লাভ করে নি, সমাজতান্ত্রিক আইন এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই চীনের নাগরিকের প্রধান রক্ষাকবচ।
(২) সোভিয়েত বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যের মতো চীনের জাতীয় গণ-কংগ্রেস তার স্থায়ী কমিটির সর্বোচ্চ গণ-আদালতকে দায়িত্বশীল করা হয়েছে; স্বাতন্ত্র্য বা নিরপেক্ষতার কথা বলা হয় নি।
(৩) সর্বোচ্চ গণ-আদালত থেকে নিম্নতম গণ-আদালত পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
(৪) চীনে বিচারকার্য সম্পাদনে বিচারক অপেক্ষা জনগণের ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠেছে। একে নিঃসন্দেহে অভিনব ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। প্রকাশ্যভাবে বিচারকার্য সম্পাদন, জনগণের সঙ্গে পরামর্শ এবং জনপ্রতিনিধি গ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করে তোলা হয়েছে। চীনের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে সফল করে সমাজতান্ত্রিক আইনের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণীবৈষম্য বজায় থাকায় আইন পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণীবৈষ্যমের বিলোপ হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক আইন যথার্থভাবে সাম্যনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্যই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্ব রয়েছে; সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে দমন করে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। বিচারকগণ সমাজতান্ত্রিক আইনের অধীনে স্বাধীনভাবে যাতে কাজ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে। গণ-আদালতের বিচারকগণ প্রশাসনিক সংস্থা, সরকারি সংগঠন বা ব্যক্তির প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করবেন বলা হয়েছে (১২৬ ধারা)।
পরিশেষে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চীনের বিচার বিভাগকে সংবিধানের ব্যাখ্যা করা অথবা আইনের বৈধতা বিচারের কোন ক্ষমতা অর্পণ করা হয় নি। এই ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে জাতীয় গণ-কংগ্রেসের তার স্থায়ী কমিটির ওপর। ১৯৯০ সালের পর সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক আইনব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইনব্যবস্থা নির্মাণে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে আইনগত তথা প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে হবে যাতে করে দেশের প্রকৃত শাসক হিসাবে জনগণের অধিকার সুরক্ষিত হয় এবং দেশের ঐক্য, সুস্থিতি ও দীর্ঘমেয়াদী শাস্তি বজায় থাকে। সংবিধানকে সুরক্ষিত করতে হবে ও আইনের সমতা ক্ষমতা পালন করতে হবে একথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।