ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পদ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন ক্যাবিনেট তোরণের কেন্দ্র-প্রস্তর; তাঁকে ঘিরে ক্যাবিনেট ঘুরতে থাকে। ১৯৩৭ সালের রাজমন্ত্রী আইনে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদের উল্লেখ করা হয়। ক্যাবিনেটের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাবিনেট গঠন, কার্যকাল এবং পতনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা হল প্রধানমন্ত্রীর। গ্রীভস বলেন যে, দেশের শাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমানে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজা বা রানী নিয়োগ করেন। কমন্সসভায় কোন দলের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে রাজা বা রানী নিজ বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁকে কমন্সসভার সদস্য হতে হবে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদাকে (Powers and Position of the British Prime Minister) চারটি ভিন্ন দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে — (১) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে, (২) কমন্সসভার নেতা হিসাবে, (৩) ক্যাবিনেটের নেতা হিসাবে, (৪) রাজা বা রানীর পরামর্শদাতা হিসাবে।
(১) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা: প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের নেতা। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপরই তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব নির্ভর করে। সুতরাং দলীয় ঐক্য বজায় রাখা তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ। নির্বাচনের সময় তাঁর দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাকে ঘিরে দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা গড়ে ওঠে। জনগণের বক্তব্য ও মতামতের ধারা অনুভব করবার ক্ষমতা তাঁর থাকা প্রয়োজন। দলের জনপ্রিয়তা এবং নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী দল ও অন্যান্য রাষ্ট্রনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীকে জনমতের প্রকৃত মূল্যায়নের যোগ্যতাসম্পন্ন এবং প্রচারদক্ষ হতে হয়। উপযুক্ত নেতৃত্ব ছাড়া দলের সংহতি এবং জনমনে দলীয় প্রভাব রাখা সম্ভব হয় না।
(২) কমন্সসভার নেতা: প্রধানমন্ত্রী হলেন কমন্সসভার নেতা। তাঁর গুরুদায়িত্ব লাঘবের জন্য প্রয়োজন হলে তিনি অন্য কোন মন্ত্রীর উপর কার্যভার অর্পণ করতে পারেন, কিন্তু চরম দায়িত্ব তাঁরই হাতে থেকে যায়। দলীয় হুইপের সাহায্যে সভার আলোচনার কর্মসূচী প্রণয়ন, বিরোধী দলের জন্য সময় বণ্টন, সভার কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্পীকারকে সাহায্য করা প্রভৃতি দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী পালন করে থাকেন। পার্লামেন্টের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিলের সমর্থনের প্রধান দায়িত্ব তাঁর। পার্লামেন্টের কক্ষে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে সমস্ত জাতির নিকট সরকারের কাজের জবাবদিহি করতে হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক স্থাপনের দায়িত্বও প্রধানত তাঁর।
(৩) ক্যাবিনেট ও প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট ও মন্ত্রীমণ্ডলীর মূল ভিত্তিস্বরূপ। প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে ক্যাবিনেটের উত্থান-পতন হয়। তিনি ক্যাবিনেটের সভায় সভাপতিত্ব করেন, রাজার সম্মতিতে অন্যান্য ক্যাবিনেট সদস্যদের মনোনীত করেন, প্রয়োজনবোধে কোন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোন মন্ত্রীর বিরোধ হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেটের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। মন্ত্রীরা বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান সমস্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। পররাষ্ট্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব ও প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেটে উত্থাপনের পূর্বে একযোগে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন। এই কারণে ক্যাবিনেট-প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব এবং মর্যাদা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
(৪) রাজা বা রানীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কঃ প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাজা বা রানীর সঙ্গে ক্যাবিনেটের সংযোগ করা হয়। ক্যাবিনেটের বক্তব্য রাজা বা রানীর নিকট উপস্থাপন করা এবং ব্যাখ্যা করবার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। তাছাড়া রাজা বা রানীর পরামর্শদাতা হিসাবেও প্রধানমন্ত্রীকে কাজ করতে হয়। তাঁর পরামর্শে কমন্সসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়, লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়, প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত করা হয়। বিবিধ সম্মানসূচক উপাধি, বিতরণ, যাজক ও বিচারক প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।