স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বোঝায়। রাষ্ট্র মানুষের অবাধ স্বাধীনতাকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকল্যাণের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে। আইন মানুষের আচার-আচরণের সীমা নির্ধারণ করে বলে স্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে। আইন হল স্বাধীনতার প্রথম রক্ষাকবচ। আইন প্রণয়ন করে সরকার এবং সরকার সমাজের মুষ্টিমেয় অংশ নিয়ে গঠিত। অনেক সময় সরকারী ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিগণ বৃহত্তর স্বার্থের কথা তুলে বিশেষ স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করতে পারে। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা দেখা দেয়। ক্ষমতা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং চরম ক্ষমতা চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং সরকারী ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও বিকৃতির বিরুদ্ধে নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতার রক্ষাকবচ অবশ্য প্রয়োজন। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়া অধিকাংশ মানুষের স্বাধীনতা সম্ভব হতে পারে না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংরক্ষণে নিম্নলিখিত রক্ষকবচগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
1. মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি: সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবন্ধ করা স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে অভিহিত করা হয়। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকলে জনগণ সেগুলি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। সরকার যদি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে জনগণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।
2. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: মন্তেস্কু, ম্যাডিসন, ব্ল্যাকস্টোন প্রমুখ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, সরকারের সমস্ত ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা বিভাগের হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ প্রয়োজন। সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হয় আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের দ্বারা। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতার পৃথকীকরণ থাকলে প্রত্যেকটি বিভাগ স্বাধীনভাবে বিভাগীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
3. আইনের অনুশাসন: অধ্যাপক ডাইসি আইনের অনুশাসন বা ‘Rule of law’-কে স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডাইসির মতে আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায়—(১) সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য, (B) আইনের চোখে সমতার নীতি অনুসরণ, (iii) সাধারণ আইন দ্বারা নাগরিক অধিকারসমূহের সংরক্ষণ। এর ফলে সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না, ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তা ছাড়া, সবার জন্য একই আইনের অস্তিত্ব থাকায় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত কেউই বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে পারে না। গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান আইনের অনুশাসনের নীতিটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছে।
4. দায়িত্বশীল সরকার: দায়িত্বশীল সরকার হল স্বাধীনতার আর একটি রক্ষাকবচ। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থায় স্যর্কিার আইনসভায় জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। তা ছাড়া, আইনসভার ভিতরে ও বাইরে বিরোধীপক্ষের সমালোচনার ভয়ে সরকার জনগণের স্বাধীনতার পরিপন্থী কোনো কাজ করতে সাহস পায় না। কারণ সুসংবদ্ধ বিরোধী দল জনমতকে সজাগ রাখতে সাহায্য করে।
5. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি: গণভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলিকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয়। সরকার নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে জনগণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এমনকি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাও সম্ভব হয়। অবশ্য বৃহদায়তন জনবহুল দেশগুলিতে এইসব পদ্ধতি অনুসরণ করা অসম্ভব। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সুইজারল্যান্ডের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি বর্তমানে আংশিকভাবে চালু রয়েছে।
6. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত। বলা হয় যে প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে শাসনবিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, যার ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, “যে রাষ্ট্রে কেন্দ্রের হাতে অতিমাত্রায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।”
7. জাগ্রত জনমত: স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হিসেবে সদাজাগ্রত জনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছা ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতার ওপর যে-কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সদাজাগ্রত থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে সংগ্রাম ও চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস বলেছিলেন যে, চিরন্তন সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা হল স্বাধীনতার মূল মন্ত্র।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা কখনও খণ্ডিতভাবে উপলব্ধি করা যায় না। সমাজের কোনো অংশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে প্রকৃত স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। তাই নিছক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এজন্য জনগণকে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।