বর্তমান কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত সংবিধানের মধ্যে ব্রিটিশ সংবিধান (British Constitution) সবচেয়ে প্রাচীন বলে দাবী করা হয়। যে কোন দেশের শাসন ব্যবস্থায় কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে এবং এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি সেই দেশের আর্থ-সামাজিক পটভূমিকার ভিত্তিতে কতকগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও থাকে। ব্রিটিশ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে (Features of the British Constitution) নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা হল।
(১) ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনশীলতা: ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হল ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনশীলতা। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ধারায় সংবিধানের মূলনীতি প্রবর্তিত হয়েছে। সমাজ জীবনের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্য-নতুন নিয়মকানুন ও প্রথার মাধ্যমে সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হয়েছে।
(২) তত্ত্ব ও বাস্তবে পার্থক্য: ব্রিটেনের সংবিধানে তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব কার্যক্রমের পার্থক্য রয়েছে। সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলির সঙ্গে বাস্তবক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার যথেষ্ট ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। সাংবিধানিক নীতি এবং কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্যটি ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তত্ত্বগতভাবে বলা হয় যে, রাজাই সকল ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী, মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাজার উপদেষ্টা কর্মচারী মাত্র।
(৩) অলিখিত ও সুপরিবর্তনীয় সংবিধান: ব্রিটিশ সংবিধান মূলত অলিখিত এবং পরিবর্তনশীল। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মত সাধারণ আইন অপেক্ষা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন কোন বিধিবদ্ধ মৌলিক সাংবিধানিক আইন নেই। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সনদ, বিধিবদ্ধ আইনের অস্তিত্ব থাকলেও ব্রিটেনের মৌলিক সাংবিধান প্রধানত অলিখিত। তা ছাড়া এর পরিবর্তনের জন্য বিশেষ কোন জটিল পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় না। অনেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ব্রিটেনের সংবিধানকে সর্বাপেক্ষা সুপরিবর্তনীয় বলেন।
(৪) পার্লামেন্টারী সরকার: ব্রিটেনে পার্লামেন্টারী সরকার প্রবর্তিত। ব্রিটেনকে পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থার জন্মভূমি বলা যেতে পারে। পার্লামেন্টারী শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য—নিয়মতান্ত্রিক শাসক ও প্রকৃত শাসকের মধ্যে পার্থক্য এবং আইনসভার নিকট শাসকবর্গের দায়িত্বশীলতা। ইংল্যান্ডের রাজা ও রানী নিয়মতান্ত্রিক শাসক, প্রকৃত শাসনক্ষমতা মন্ত্রীসভার হাতে। তাছাড়া আইনসভা বা পার্লামেন্টের নিকট শাসকদের দায়িত্বশীলতা জনগণের ক্ষমতাকে স্পষ্ট রূপ দিয়েছে। পার্লামেন্টের সদস্যগণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন।
(৫) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি: ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হয়নি। ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যায় যে, এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করে, একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সাথে জড়িত থাকেন এবং এক বিভাগ প্রয়োজনবোধে অন্য বিভাগের কাজ করে। সুতরাং আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া লর্ডসভা বা আইনসভার উচ্চকক্ষ ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ-আপীল আদালত হিসাবে গণ্য। এখানে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায়।
(৬) বিচার বিভাগের প্রাধান্য নেই: ব্রিটেনের বিচার বিভাগ আমেরিকার মত শক্তিশালী নয়। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করে তাকে ‘সংবিধান বিরোধী’ বলে ঘোষণা করতে পারে। ব্রিটেনের বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেও তার বৈধতা বিচার করতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের প্রাধান্য নেই।
(৭) অগণতান্ত্রিক উপাদান: গণতন্ত্রের কেন্দ্রচ্ছায়া হলেও ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় অনেক অগণতান্ত্রিক উপাদানের ছাপ রয়েছে। একদিকে রাজতন্ত্রকে আজও অপরিহার্য উপাদান বলে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে লর্ডসভার মত অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এখনও বর্তমান রয়েছে। স্থানীয় সরকারগুলিতে বাইরে থেকে সদস্য গ্রহণ করার নীতিকেও অগণতান্ত্রিকতা মনে করা যায়।
(৮) দ্বিদলীয় ব্যবস্থা: ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় দুটি রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত, এ কারণে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। শ্রমিক দল ও রক্ষণশীল দলের সুস্পষ্ট প্রাধান্য এই ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে উভয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও বাস্তবে উভয় দলই ব্রিটেনের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট।
(৯) সাংবিধানিক রীতিনীতি: ব্রিটিশ সংবিধানের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল সাংবিধানিক রীতিনীতি (Convention)। বলা যেতে পারে যে, সাংবিধানিক রীতিনীতিগুলি ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব করেছে। সাংবিধানিক রীতিনীতির সংখ্যাধিক্য এবং আপেক্ষিক গুরুত্বের জন্য ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত সংবিধান বলে অভিহিত হয়।
(১০) আইনের অনুশাসন: আইনের অনুশাসন (Rule of Law) ইংল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। আইনের অনুশাসনের অর্থ হল আইনের দ্বারা শাসন এবং আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। সরকারকে সকল সময়ে আইনের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে, অর্থাৎ বেআইনীভাবে কোন ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। তা ছাড়া, এই আইন পদমর্যাদা নির্বিশেষে সকলের ওপর প্রযোজ্য।