মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আইনসভা বা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ হল সিনেট (The Senate)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সিনেট সভা এমন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে যা অন্য কোন দেশের উচ্চকক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি অর্থাৎ অঙ্গরাজ্যগুলির সমান প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সিনেট সভা গঠিত হয়। প্রতি অঙ্গরাজা থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে বর্তমানে সিনেট সভায় ১০০ জন প্রতিনিধি আছেন। সমান প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা অনেকে অগণতান্ত্রিক মনে করেন। কারণ এতে ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যগুলির জনসংখ্যা কম হলেও সমান সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাতে পারে। নিউইয়র্ক রাজ্যের জনসংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লক্ষ, আর নেভাডার (Nevada) জনসংখ্যা ৩১ লক্ষ ৯৫ হাজার হলেও উভয় রাজ্য ২ জন করে সদস্য নির্বাচন করে।
তা ছাড়া পূর্বে সিনেট সভার সদস্যগণ অঙ্গরাজ্যের আইনসভার দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হতেন। বর্তমানে জনসাধারণ-কর্তৃক সিনেটদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়েছে। সিনেটরগণ ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রতি দু’বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন। কোনও অঙ্গরাজ্যে একই সময়ে দুজন সিনেটরের পদ শূন্য হয় না। সুতরাং কোন অঙ্গরাজ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে দুটি দল থেকে দুজন সদস্যের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। সিনেট সভার সদস্যগণ পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন কোন সরকারী পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। সিনেট সভার সভাপতিত্ব করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতি। উপরাষ্ট্রপতি ছাড়া মার্কিন সিনেটের অপর একজন কর্মকর্তা সিনেট সদস্যগণ-কর্তৃক সদস্যদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন; তাঁকে অস্থায়ী সভাপতি বলা হয়। উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে তিনি সভাপতিত্বও করেন এবং পৃথক বেতন লাভ করে থাকেন। সিনেট সভার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি আছে এবং সেই কমিটিগুলির মাধ্যমেই সিনেট সভা কার্য সম্পাদন করে থাকে।
□ মার্কিন সিনেট সভা ও অন্যান্য দেশের উচ্চকক্ষ: পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উচ্চকক্ষের ভূমিকার সঙ্গে সিনেট সভার ভূমিকা তুলনা করলে দেখা যাবে যে, সিনেট সভা কেবলমাত্র মার্কিন প্রতিনিধি সভা অপেক্ষাই শক্তিশালী নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উচ্চকক্ষ অপেক্ষা বেশি শক্তিশালী।
□ ব্রিটেন: ব্রিটেনে লর্ডসভার আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা ১৯১১ এবং ১৯৪৯ সালে পার্লামেন্ট আইনে সংকুচিত হয়েছে। লর্ডসভা অর্থ-সংক্রান্ত বিল ছাড়া অন্যান্য বিল পাসে মাত্র এক বছর বিলম্ব করাতে পারে। অর্থ-সংক্রান্ত বিল কমন্সসভা-কর্তৃক গৃহীত হবার পর একমাসের মধ্যে লর্ডসভা তাতে সম্মতি না দিলে লর্ডসভার অনুমোদন ছাড়াই ঐ বিল রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য পাঠানো যায়। অর্থ-সংক্রান্ত বিলের সংশোধন করতে লর্ডসভা অসমর্থ। কমন্সসভা ইচ্ছা করলে লর্ডসভার আপত্তি সত্ত্বেও যে-কোন বিলকে আইনে পরিণত করতে পারে।
□ অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়ার উচ্চকক্ষ সিনেট সাধারণ আইনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভার সঙ্গে সমান ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু অর্থ-সংক্রান্ত বিল নিম্নকক্ষে উত্থাপিত হয় এবং সিনেটের প্রত্যাখ্যান করবার ক্ষমতা থাকলেও অর্থবিল সংশোধন করবার কোন ক্ষমতা নেই। উভয় কক্ষের মধ্যে মতবিরোধের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল উভয় কক্ষকেই ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচনের পরও উভয় কক্ষের মতবিরোধ দূর না হলে, উভয়কক্ষের যুক্ত অধিবেশনে সংখ্যাধিক্যের ভোটে প্রস্তাবের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়। সিনেট অপেক্ষা প্রতিনিধি সভার সদস্য সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় প্রতিনিধি সভারই সুনিশ্চিত জয় হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিনেট মার্কিন সিনেটের ন্যায় নিয়োগ ও চুক্তি-সংক্রান্ত কোন ক্ষমতা ভোগ করে না।
□ কানাডা: কানাডার শাসনব্যবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় যে, অর্থসংক্রান্ত বিল নিম্নকক্ষে (House of Commons) উত্থাপিত হওয়া ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে কানাডার সিনেট নিম্নকক্ষের সমান ক্ষমতার অধিকারী। অর্থবিল সংশোধন এবং প্রত্যাখ্যান করবার ক্ষমতাও সিনেটের রয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ হাউস অফ কমন্সই বেশি ক্ষমতা ভোগ করে থাকে উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যগণ গভর্নর-জেনারেল কর্তৃক আজীবন সদস্য হিসাবে মনোনীত হন; ফলে মার্কিন সিনেট অপেক্ষা এর মর্যাদা কম। অন্যদিকে কানাডার নিম্নকক্ষ হল জনসাধারণের প্রতিনিধি-স্থানীয় সংস্থা। কার্যতঃ এই সংস্থাই অধিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।
□ সুইজারল্যান্ড: সুইজারল্যান্ডের উচ্চকক্ষ (Council of State) নিম্নকক্ষের (National Council) সমান ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যতা উচ্চকক্ষের ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। এখানেও উচ্চকক্ষ অপেক্ষা নিম্নকক্ষের সদস্য হওয়াই অধিকতর মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
□ ফ্রান্স: ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতান্ত্রিক সংবিধানে উচ্চকক্ষ সিনেট (Senate) নিম্নকক্ষ জাতীয় সভার (National Assembly) তুলনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করে থাকে। আইন প্রণয়ন বা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের চেয়ে ক্ষমতাশালী নয়। সামগ্রিক বিচারে বলা যেতে পারে যে, ফ্রান্সের বর্তমান সংবিধানের দ্বিতীয় কক্ষ সিনেট পূর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদায় ভূষিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সভার ন্যায় ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করে না।
□ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নঃ সোভিয়েট ইউনিয়নের (১৯৭৭ সালের সংবিধান) উচ্চকক্ষের (Soviet of Nationalities) সদস্যগণ মার্কিন সিনেটের ন্যায় জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হতেন। মার্কিন সিনেট অপেক্ষা সোভিয়েট ইউনিয়নের উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা বেশি এবং উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষের (Soviet of the Union) সমান ক্ষমতাসম্পন্ন। সুতরাং উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী নয়।
□ ভারত: ভারতের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা (Rajya Sabha) নিম্নকক্ষ লোকসভার (Lok Sabha) সঙ্গে সাধারণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমান মর্যাদা ভোগ করে। কিন্তু অর্থ-সংক্রান্ত বিল একমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপিত হয়। রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে অর্থ-সংক্রান্ত বিল সম্পর্কে মতামত জানাতে হয়। ১৪ দিন পর রাজ্যসভার বিনা অনুমোদনে লোকসভা-কর্তৃক অর্থবিল গৃহীত হতে পারে। রাজ্যসভা অর্থবিল সংশোধন করতে পারে, কিন্তু রাজ্যসভার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা লোকসভার রয়েছে। সুতরাং অর্থ-সংক্রান্ত বিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ভারতের রাজ্যসভা অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী।
• মূল্যায়ন: সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কেবলমাত্র যে আমেরিকার প্রতিনিধি সভা অপেক্ষা ক্ষমতাশালী তা নয়, অন্যান্য দেশের উচ্চকক্ষগুলির মধ্যে আমেরিকার সিনেট সবচেয়ে শক্তিশালী (“The powers of the Senate are very great. Probably no second chamber in the world today has an influence so real and, direct.” — Strong)
সুতরাং লর্ড রাইসকে অনুসরণ করে বলা যায় যে, সংবিধান প্রণেতাগণ সিনেট সভার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ‘রাজতান্ত্রিক উচ্চাশা’ (‘monarchical ambitions’) এবং প্রতিনিধি সভার ‘গণতান্ত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতা’ (‘democratic recklessness) নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। সিনেট সভা এই দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে এসেছে।
• সীমাবদ্ধতা: সিনেটের ব্যাপক প্রাধান্য ও ক্ষমতা সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে অনেক লেখক মনে করেন।
প্রথমত, ফাইনার-এর মতে অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্বের নীতি সিনেটের প্রতিনিধিত্ব-মূলক চরিত্র ক্ষুন্ন করেছে। অল্প জনসংখ্যাসমন্বিত গ্রামীণ ও দরিদ্র রাজ্যের সংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ নগরকেন্দ্রিক ও শিল্পকেন্দ্রিক রাজ্যের অপেক্ষা অধিক হওয়ায় সমানাধিকারের নীতি ক্ষুন্ন হয়েছে (“Since there are more sparsely States, more rural States and more poor states than there are densely populated, urbanised and industrialised wealthy States, this immediately distorts the representative character of the very powerful Upper House of U.S. congress.” — S. E. Finer)।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন সিনেট অশ্বেতকায় শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের যথাযথ ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমী গণতন্ত্রের আদর্শ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণে কোন সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নি।
তৃতীয়ত, সিনেটের কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সদস্যদের বক্তব্য দীর্ঘায়িত করে অযথা কালক্ষেপণ করবার সুযোগ (filibusering) থাকায় দ্রুত কাজ সম্পাদন সিনেটের আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মার্কিন সমাজব্যবস্থায় সিনেটের প্রভাব ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রয়েছে।